এক যাযাবর লক্ষ্যবিহীন (বড়গল্প – তিন )

(বড় গল্প – দুই)

ট্রেনটা অনেকক্ষণ ধরে ভুল পথে চলেছে, লোকটার কোন হুঁশ নেই, এক মনে কি যেন ভেবে চলেছে। এতক্ষণে ভিসুভিয়াস পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু, প্রায় দু’ ঘন্টা কেটে গেছে এখনো ভিসুভিয়াসের কোন নাম গন্ধ নেই, শুধু দুই ধারে ইতালির গ্রামের সুন্দর দৃশ্য। হঠাৎ লোকটার খেয়াল হল যে ও ভুল দিকের ট্রেনে চেপে পড়েছে। নেপলস থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে ষ্টেশনে এসে সারকাম্ভিসুভিয়ানা লাইনে সামনে যে ট্রেন পেয়েছে চেপে পড়েছে, অবশ্য উদ্দ্যেশ্য ছিল ভিসুভিয়াস পৌঁছনোর।

সেখানে ভিসুভিয়াসের পাদদেশের এক ছোট্ট গ্রামে ফার্মে চাষের কাজের জন্যে লোক চাই – নেপলসের এজেন্ট বলে দিয়েছিল। লোকটার উদ্দ্যেশ্য কোন রকমে সেখানে পৌঁছে যাওয়া, তাহলেই কিছু দিনের জন্যে হিল্লে হয়ে যাবে, গা ঢাকা ও দেওয়া যাবে। বিনা টিকিটের যাত্রী, বিনা পরিচয়ের যাত্রী, তাও আবার বিদেশ বিভূঁইয়ে। সর্বদা মনে এক আশঙ্কা, তাই খেয়াল ছিল না। যখন খেয়াল হল, ভুল পথে সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।

অবশ্য নানান দেশের পুলিশের তাড়া খেতে খেতে লোকটার যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। তবুও, ইতালির পুলিশ অনেক দয়ালু, নেপলসে ওকে একবার পুলিশ ধরেছিল, সঙ্গে ইতালিতে থাকার কোন বৈধ কাগজপত্র না থাকার দরুন কিন্তু কিছুই শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল – পনেরো দিনের মধ্যে নিজের দেশে ফিরে যেতে। লোকটা তো দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে আসে নি।

সে এসেছে এখানে ‘এল দোরাদোর’ খোঁজে। ইউরোপে আছে অপার ঐশ্বর্য, শুধু মুঠো মুঠো করে কাঁড়ি কাঁড়ি ধন রাশি উপার্জন করেই ফিরে যাবে দেশে। ‘এল দোরাদর’ খোঁজে আসার আগে সে তার নিজের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে এসেছে। তার যে ফেরার পথও বন্ধ। তাছাড়া, দেশে ফেরার টাকাও নেই তার কাছে। একবেলা খাওয়ার টাকাও নেই।

নেপলসে আসার আগে কয়েক বছর সে ছিল পশ্চিম গ্রীসের এক প্রত্যন্ত গ্রাম মানোলাদার এক স্ট্রবেরি ফার্মে। সেখানে সে রীতিমত বন্দীই ছিল বলা যায়। উঁচু কাঁটাতার ঘেরা, মাইলের পর মাইল সেই স্ট্রবেরি ফার্মে একবেলা খাবারের বিনিময়ে দিন রাত কাজ করতে হত, খুবই কষ্ট করে ফার্মের এক পাশে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হত। না ছিল খাবার জল, না ছিল বিদ্যুৎ, বাথরুম – নরকের আরেক নাম ছিল তার সেই আস্থানা। তবুও ও ভেবেছে কষ্ট করে থেকে, কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন করেই ফিরে যাবে দেশে কিংবা আরও অর্থ উপার্জনের জন্যে পাড়ি দেবে ইউরোপের অন্য দেশে। কিন্তু মানোলাদার স্ট্রবেরি ফার্মে কাজ করা যে বন্দী দশার আরেক রূপ হবে সেটা সে বিন্দু মাত্র আঁচ করতে পারে নি আগে।

স্ট্রবেরি গাছের মাটি তৈরি থেকে শুরু করে স্ট্রবেরি তোলা, প্যাকেট করা সমস্তই করতে হত ওদের। স্ট্রবেরির তো আবার খুবই যত্ন চাই। এক একটা টুসটুসে লাল রসালো স্ট্রবেরির গায়ে এক ফোঁটা মাটি যাতে না লাগে – সেই দিকে কড়া নজর রাখতে হয়। স্ট্রবেরি গাছে ফল আসার আগেই স্ট্রবেরি গাছের নীচে প্ল্যাস্টিক বা খড়ের বিছানা বিছিয়ে দিতে হয়।

ওখানে ওরা প্রায় দেড়শ জন কর্মচারী ছিল, কিন্তু, কখনোই ফার্মের মালিকের দেখা পায় নি। কয়েক জন দালাল ওকে এই কাজে ঢুকিয়েছিল নানা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে। সে ভেবেছিল, হয়তো এতো দিনে ওর ইউরোপে আসা সার্থক হয়েছে – কাজ পেয়েছে। এবার বাড়ীতে টাকা পাঠাতে পারবে।

কিন্তু, বিধি বাম। কাজ করার শুরু থেকে এক টাকাও সে পায় নি, এমনকি কয়েক মাস কাজ করে, স্ট্রবেরি তোলার সময় ওদের মধ্যে কয়েক জন বকেয়া বেতন মিটিয়ে দেওয়ার জন্যে বিদ্রোহ করেছিল, নিজেদের শ্রমের নাজ্য টাকা চেয়েছিল বলে সবার সামনেই ওদের গুলি করে মেরে ফেলল ঐ দালালরা। তাঁদের দেহের রক্তের ছিটে এসে লোকটার শরীরেরও পড়েছিল। আতঙ্কে কেউই টুঁ শব্দ করে নি, কারণ সবাই যে এখানে নাম গোত্রহীন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। গ্রীস সরকারের কোন নথিপত্রে ওদের যে কোন অস্ত্বিত্বই নেই। সেই দিন থেকে পশ্চিম গ্রীসের মানোলাদার সেই স্ট্রবেরি ফার্ম থেকে পালানোর পথ খুঁজেছে ও এবং আরও অনেকে।

                                                                                                   চলবে

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Uncategorized and tagged , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s