পৃথিবীতে কোন কাজই ছোট হয় না – সেই কথা তো জানি, কিন্তু, তা বলে আমাকে এটাও বিশ্বাস করতে হবে! ব্রাজিলে যদি একটি প্রজাপতি পাখা নাড়ায়, সেই পাখা নাড়ানোর হাওয়ায় জাপানে সুনামি, বা টেক্সাসে টর্নেডো আসতে পারে? কিংবা হিমালয়ের কোলে এক প্রজাপতির পাখার কাঁপনে ক্যারাবিয়ান সাগরে হ্যারিকেন আসতে পারে?
কথাটা শুনে যতই আশ্চর্য লাগুক না কেন – কথাটির পেছনে কিন্তু প্রচুর বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে। আর সেই বৈজ্ঞানিক যুক্তি শুধু বিজ্ঞানের বন্ধ দরজায় সীমাবদ্ধ নয় – মানুষের জীবন, সমাজ, দেশ, মানুষের ইতিহাস – সব জায়গাতেই সেই প্রজাপতির পাখার কম্পনে তৈরি ঝড়ের গল্প লুকিয়ে আছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরুই হয়েছিল একটি হত্যা থেকে।
সার্বিয়ার এক স্বদেশী Gavrilo Princip, অষ্ট্রিয়ার Archduke Franz Ferdinand ও তার স্ত্রীকে বসনিয়ার রাজধানীতে হত্যা করেছিল। আর সেই হত্যার বদলা নিতে অষ্ট্রিয়া, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল, তারপর যুদ্ধের সেই আগুনের আঁচ লাগলো ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর উপরে।
সেই দুইটি হত্যার বদলা নিতে মাত্র পনেরো দিনের মধ্যেই ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক দেশ একে ওপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল – শুরু হয়ে গেল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ। ভয়াবহ সেই বিশ্ব যুদ্ধে নিহত ও আহতের সংখ্যা পনেরো মিলিয়নের কাছাকাছি ছিল – আর সেই অর্থহীন যুদ্ধ, যা কিনা শুরু হয়েছিল এক ছোট্ট ঘটনা থেকে, তার ভয়াবহ ও করুণ পরিনতি দেখে সমাজ বিজ্ঞানীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল।
এমনকি, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষে সেই হিংসার রেশ রয়ে গিয়েছিল – তখন হিটলার উঠে আসছিল, কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবী আরও ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ দেখেছিল। গত শতাব্দীর দুই বিশ্ব যুদ্ধের সত্যিকারের আসল কারণ ছিল খুবই ছোট। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগের একশো বছর ধরে ইউরোপের দেশগুলোর ব্যবস্থা যখন ছিল স্থায়ী – stable, সেই ব্যবস্থায় একটু টোকা দিতেই একই শতাব্দী দুই দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ দেখে নিল। তাহলে কি পৃথিবীতে স্থায়িত্ব বা stability বলে কিছু হয় না?
পৃথিবীর বুকে ছোট কারণে ঘটে যাওয়া এই ধরণের বড় ধরণের ঘটনা যা সমাজে instability এনে দেয় – সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলল। মানুষ তখন জানতো পৃথিবীর বুকে সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী, আবহাওয়া, রাজনীতি, অর্থনীতি খুবই শৃঙ্খলাবদ্ধ, সাজানো। এক ছোট্ট ঘটনা যে সমস্ত সাজানো ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিতে পারে, তার পেছনে যে কোনো অংক ও তার কোনো সমাধান কাজ করে, তা জানা ছিল না।
বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞান সেই অস্থায়িত্বের উত্তর নিয়ে এলো – জন্ম দিল অঙ্কের এক নতুন শাখা, এক নতুন থিয়োরি – Chaos theory । আর সেই থিয়োরির জন্ম দাতা Edward Norton Lorenz, সেই ছোট্ট কারণে বড়সড় ভাবে পালটে যাওয়া সম্পূর্ণ অজানা ভবিষ্যতের নাম দিলেন butterfly effect। আর, ‘butterfly effect’ আবহাওয়া থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত চলমান সিস্টেমের জন্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করল। বিজ্ঞান বলল যে – জটিল সিস্টেমে যত বেশী স্থায়িত্ব তত বেশী অস্থায়িত্বের সম্ভাবনা। প্রায়ই দেখা গেছে, প্রকৃতিতে বর্তমানে ঘটা কোন এক ছোট ঘটনা সুদূর ভবিষ্যতে বিশাল হয়ে দেখা যায়।
বিশেষ করে অর্থনীতিতে খুব বেশী butterfly effect লক্ষ্য করা যায়, ছোট ঘটনার সুদূর প্রসারী ফল দেখা যায় – যেমন ২০০৮ এ আমেরিকাতে Lehman Brothers এর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় বোম্বে বা আহমেদাবাদের কি আসে যায়, কিন্তু, না, ঐ একটা ঘটনাই বিশ্বের শেয়ার বাজারে ধস নামিয়ে দিল। এমনকি ১৯২১ এ আমেরিকার গ্রেট ডিপ্রেশনের পেছনেও ছিল butterfly effect।
আসলে অর্থনীতির কোন সিস্টেম যখন খুব স্থায়ী হয়ে যায়, মানুষ সেই সিস্টেমের উপরে এতো বিশ্বাস করে, ও সেই সিস্টেমের কাছে মানুষের চাহিদা বেড়ে যায়, লাভের আশা করে করে অনুমান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে কোন জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয় – যেমন, কোন এক জায়গার ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে, মানুষ লাভের আশায় কিনে চলেছে, সবাই জানে দাম বাড়ছে, বাড়ছে – সবই ভালো চলছে, মানুষ নিজের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে গিয়েও ফ্ল্যাট কিনে চলেছে, কিন্তু, আসল ফ্ল্যাটের দাম আসলে সেটা নয়, অনেক কম। আর ঠিক সেই সময়েই কেউ একজন কোন এক ফ্ল্যাট খুব সস্তায় বিক্রি করে দিল – ব্যাস ফ্ল্যাটের বাজার দর হুরহুর করে পড়তে শুরু করল। আমেরিকাতে ঠিক তাই হয়েছে। যেখানেই, stability ও স্পেকুলেশন সেখানেই instability, সেখানেই প্রজাপতির পাখার কাঁপনে ঝড় আসে।
এক ছোট্ট ঘটনা, যা আপাত দৃষ্টিতে খুবই ছোট্ট বলে মনে হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল হয়ে দেখা দেয় – সেই কঠিন ভবিষ্যতকে জানা বিজ্ঞানের পক্ষেও খুব মুশকিল, বিজ্ঞানও সেই অস্থায়িত্বের স্থায়ী উত্তর খুঁজে চলেছে – প্রকৃতির সিস্টেমকে নিজের আয়ত্ত্বে এনে ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করে চলেছে।
আসলে, বর্তমান শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি আরও বেশী জটিল হয়ে উঠেছে, আর সিস্টেমে যত বেশী জটিলতা তত বেশী অস্থায়িত্ব বা instability – তাই জাপানে সুনামি হলে ইউরোপের বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
শুধু কি বৃহৎ ক্ষেত্রে অর্থনীতি, রাজনীতিতেই প্রজাপতির পাখার কাঁপনে ঝড় ওঠে? মানুষের জীবনেও ছোট্ট কোন এক ঘটনা ক্ষণিকেই জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দেয়, জীবনকে এক নতুন খাতে বইয়ে দেয়। মানুষের জীবনও যে প্রজাপতির পাখার কাঁপনের উপরে নির্ভর করছে – আসলে, প্রকৃতির সবই তো একই সূত্রে বাঁধা। মানুষের ইতিহাসই যেন প্রজাপতির পাখার কম্পনের উপরে তৈরি হয়েছে।
মানুষ প্রকৃতির সমস্ত শক্তিকে একে একে হাতের মুঠোয় এনে, প্রকৃতির ঘটনাবলীকে কন্ট্রোল করে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে, মানুষকে এক শৃঙ্খলাবদ্ধ ভবিষ্যৎ, স্থায়ী অর্থনীতি, স্থায়ী রাজনীতি দিতে চেয়েছে। কিন্তু, ঐ ছোট্ট প্রজাপতির পাখার শক্তিকে মানুষ ভুলে গিয়েছিল – প্রজাপতিটি যে ক্রমাগত পাখা নাড়িয়েই চলেছে, মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়তিকে নির্ধারণ করে চলেছে।
ভিন্ন রকমের পোস্ট। অনেক ভালো লাগলো আপনার সাবলীল লেখা। Butterfly Effect সম্পর্কে জানলাম।
শুভেচ্ছা রইল।
ধন্যবাদ। আপনাকেও অসংখ্য শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকবেন।
পিংব্যাকঃ বাটারফ্লাই ইফেক্ট । প্রজাপতির পাখায় ঝড় | জানো-জানাও