মধ্যযুগে ইউরোপে, মানুষের তৈরি সবচেয়ে জটিল যন্ত্র হিসাবে পাইপ অর্গান গণ্য হত – এক বিশেষ ধরণের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। প্রায় কয়েক হাজার পাইপের সমন্বয়ে তৈরি বিশাল এই জটিল যন্ত্রটি সেই সময়ের ইউরোপে, সুরসাধনার এক বিশেষ অঙ্গ ছিল।
সেই সময় ইউরোপের নানান কনসার্ট হল, থিয়েটার হল, ক্যাথিড্রাল থেকে শুরু করে বড়লোকের বাড়ীতেও এই বাদ্যযন্ত্রের স্থান হোতো, এমনকি, এই কিছুদিন আগেও নির্বাক চলচিত্রে আবহ সঙ্গীত তৈরি জন্যে ইউরোপের থিয়েটার গুলোর এক পাশে এই যন্ত্র স্থান পেতো – নির্বাক চলচিত্র চলার সময়ে পাইপ অর্গান বাজানো হোতো, তারপর, তো টেকনোলোজির সজোর ধাক্কায় বিশাল এই বাদ্যযন্ত্রটি কোণঠাসা হতে হতে প্রায় লুপ্তই বলা যায়, অবশ্য, বর্তমানে ইউরোপের প্রাচীন ক্যাথিড্রালের দেওয়ালে এই বিশাল এন্টিক বাদ্যযন্ত্রের দেখা পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও আবার কয়েকশো বছরের পুরনো যন্ত্রটি আজও সচল।
বেশ জায়গা নিয়ে প্রাচীন ক্যাথিড্রালের একপাশে এক আভিজাত্য নিয়ে অবস্থান করে কয়েকশো বছর পুরনো এই পাইপ-অর্গান। তুলুস ক্যাথিড্রালে যে পাইপ অর্গান দেখা যায়, সারা বছরই প্রায় নিস্তব্ধই থাকে বলা যায়।
কয়েক ধাপে সাজানো কি বোর্ড, প্রচুর পাইপ, প্যাডেল – ইত্যাদি নিয়ে বেশ জটিল এই যন্ত্রটি, যেমন, ষাট নোটের কি বোর্ড যদি দশটা গ্রুপের পাইপকে কন্ট্রোল করে, তবে ছয়শটা পাইপ থাকে। কীবোর্ডের ধাপ বাড়লে পাইপের সংখ্যাও বাড়ে, এই ভাবে পাইপের সংখ্যা হাজারও ছাড়াতে পারে। আর প্রত্যেকটা পাইপে বিশেষ পরিমানের বাতাসের চাপ তৈরি হলেই সুরেলা সুর সৃষ্টি হয়।
পাইপ অর্গানের প্রচুর পাইপ যেখানে রাখা হয়, সে একটা ছোটখাটো ঘরই বলা যায়। অবশ্য, বাইরে থেকে পাইপ অর্গানের সমস্ত পাইপ গুলোকে দেখা যায় না – সাধারণত কয়েকটা পাইপ দিয়ে সাজানো সুন্দর এক ফ্রেমকেই বাইরে থেকে দেখা যায়, তাই এই পাইপ অর্গান ক্যাথিড্রালের একদিকের দেওয়ালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে – প্রাচীন ইউরোপিয়ান ক্যাথিড্রালের এক অলংকার এই পাইপ অর্গান।
এই পাইপ অর্গান বাজানোর জন্যে নাকি বিশেষ ধরণের ট্রেনিং চাই। ধীরে ধীরে এই পাইপ অর্গানে সুর তোলার মানুষের সংখ্যা নাকি কমে যাচ্ছে। তবুও তুলুসের ক্যাথিড্রালে বছরে অন্তত একবার, ক্রিসমাস ইভে এই পাইপ অর্গানের সুর শোণা যায়।
ক্রিসমাসের সময় একবারই পাইপ অর্গানের সুরেলা সুর শুনেছিলাম – গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ এক সুর ছড়িয়ে পড়ছিল প্রাচীন ক্যাথিড্রালের বিশাল হলে – ক্যাথিড্রালের বিশাল থামের আড়ালে থমকে থাকা আবছায়া হলুদ আলো আঁধারি, মধ্যযুগীয় বাদ্যযন্ত্রের সুর, ক্যাথিড্রালের ভেতরের গভীর শীতলতা – সব মিলিয়ে, যেন এক অদ্ভুত, অজাগতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। উপরের দিকে কোণের এক ঘরে বসে এক ফরাসী ভদ্রলোক একমনে পাইপ অর্গানটি বাজিয়ে চলেছিল – মুখে ছিল এক স্মিত হাসি।