দিগন্ত বিস্তৃত আঙুর ক্ষেত, যেন পৃথিবীর শেষ সীমানায় গিয়ে আকাশের নীলে মিশে যায় – এমনি ছবি দক্ষিণ ফ্রান্সের গ্রামের দৃশ্যপটে এতোই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে, যে, দিগন্ত বিস্তৃত আঙুর ক্ষেত দেখে দেখে চোখ সয়ে যায়, আলাদা করে দেখার ইচ্ছেটা যেন হারিয়ে যায়।
কিন্তু, সেবার সামারে যখন আঙুর ক্ষেতের মাঝে ক্যাম্পিং ও কয়েক রাত কাটানোর সুযোগ এলো, আঙুর ক্ষেতের বিস্তারিত দৃশ্য থেকে যে আর চোখ ফিরিয়ে থাকা গেল না। আর ঠিক সেই সময়েই আঙুর পাকার মরশুম ছিল – তাই, আঙুর ক্ষেতের মাঝ বরাবরের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে থোকায় থোকায় পাকা আঙুর পেড়ে নিয়ে মুখে ফেলতেও কোন বাঁধা নেই – যত ইচ্ছে আঙুর পেড়ে নেওয়ার ছিল অবাধ স্বাধীনতা। ভোরের শিশির তখনো বড় মমতায় আঙুরের থোকা গুলোর গায়ে জড়ানো ছিল।
ফরাসীরা মূলত ওয়াইন তৈরি জন্যেই নানা ধরণের আঙুর চাষ করে, ইউরোপে আঙুর চাষ ও আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরির ইতিহাস প্রায় কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ইউরোপে, প্রাচীন কালে ওয়াইন তৈরির ফর্মুলা একমাত্র চার্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তারপর রোমানদের কাছে বহুদিন ধরে গুপ্ত ছিল। রোমানরা ইউরোপের যে জায়গায় বিস্তার করেছে, সেখানে নিয়ে গেছে আঙুর চাষের প্রণালী ও আঙুর চাষ। বিশেষ করে ফ্রান্সে আঙুর চাষ প্রথম রোমানরাই এনেছিল, এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আবহাওয়া আঙুরের জন্যে ‘অতি উত্তম’ প্রমানিত হয়েছিল।
তারপর তো গত কয়েকশো বছর ধরে ফরাসীরা বংশ পরম্পরায় আঙুর চাষ করে আসছে, ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশী জমি আঙুরের দখলে। ফ্রান্সে আঙুর চাষ নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা হয়। আঙুর চাষ ও ওয়াইন শিল্প ফ্রান্সের অর্থনীতির এক মোটা স্তম্ভ – তবে এতেও চীন দখল বসিয়ে দিয়েছে। চীনও বর্তমানে আঙুর চাষের জমির ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে ছাড়িয়ে গেছে, চীনেও তৈরি হয় ফরাসী ওয়াইন!
আর চীন যেখানে হাত বাড়ায়, প্রোডাকশন তো বেড়েই যায়, বেড়ে যায় সাপ্লাই – তাই, দেখা গেছে বিশ্বের বাজারে ওয়াইন এতোই বেড়ে গেছে, আর প্রয়োজন কমে গেছে, আর ওয়াইন বিক্রি করাটা নাকি বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাইহোক, ফরাসীরা অবশ্য ফরাসী ওয়াইনই পছন্দ করে।
সাধারণত আঙুর লতানে গাছ, কিন্তু, ভালো আঙুর উৎপাদনের জন্যে নিয়মিত আঙুর গাছ ছাঁটাই করা হয়, ক্ষেতের সমস্ত গাছ যেন সমান উচ্চতার হয়, সে দিকে কড়া নজর রাখা হয়। শীতের শেষে শুকনো আঙুর গাছ গুলোর ডাল কেটে দিয়ে বসন্তের অপেক্ষা করতে করতে গাছের ডাল নতুন শাখায় ভরে যায় – তারপর গাছে সামারের শুরুতেই আঙুর ফল চলে আসে, জুলাই আগস্টের মধ্যে দক্ষিণ ফ্রান্সে আঙুর পাকতে শুরু করে দেয়।
আর আঙুর ক্ষেতে আঙুরের ফুল ফোঁটা থেকে শুরু করে আঙুর পাকা পর্যন্ত সময়ে আঙুর ক্ষেতের নানান ধরণের যত্ন করে যেতে হয় – সে আগাছা দমন থেকে শুরু করে, কীটনাশক ছিটানো, গাছের ডাল ছেঁটে দেওয়া – সব করে যেতে হয়, আঙুরের থোকা গুলোতে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো পড়া দরকার, তাতেও ওয়াইনের কোয়ালিটি নির্ভর করে।
আবার, কীটনাশক ছড়ানোর ক্ষেত্রে ফরাসীরা খুবই সাবধানী – একটু বেশী হয়ে গেলে ওয়াইনের কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ফরাসীরা আঙুর ক্ষেতে খুবই মাপজোক করে কীটনাশক ছড়ায়।
আঙুর পেকে গেলে বিশাল বাগানের নানা দিক থেকে অল্প কিছু আঙুর তুলে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় – আঙুরের চিনির পরিমাণ, আঙুরের মিষ্টতা মাপার জন্যে। আঙ্গুরে যখন সঠিক পরিমানের মিষ্টতা তৈরি হয়, জানা যায়, মাঠ থেকে আঙুর তোলার সময় হয়ে গেছে – ভোরের আলো ফোঁটার আগেই শুরু হয়ে যায় আঙুর তোলার কাজ, সূর্যের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই আঙুর তুলে ফেলতে হয় – না হলে নাকি ভালো ওয়াইন তৈরি হয় না। যেহেতু, বিশাল বাগানের আঙুর খুব তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে হয় – কাজে নামে, আঙুর তোলার বিশাল দৈত্যাকার মেশিন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিশাল মাঠের আঙুর চলে যায় ওয়াইন তৈরির ফ্যাক্টরিতে।
আমাদের চোখের সামনে দিয়ে আঙুর তোলার দৈত্যাকার মেশিন আঙুর তুলে নিয়ে যাওয়ার পরেও দেখি বাগানে তখনো প্রচুর আঙুর। মেশিনের হাত সেখানে পৌঁছয় নি – বাগানের মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ তো ওখানে আরও কত আঙুর আছে। তুলবে না? সে হেসে বলল – ও থাক, পাখির জন্যে।
দিগন্ত বিস্তৃত আঙুর ক্ষেত পরের বছরের সামারের অপেক্ষায় আবার দিন গুনতে শুরু করে।