মা কে আমার যে ভাষায় প্রথম ‘মা’ বলে ডাকা শিখেছিলাম তাই তো আমার মায়ের ভাষা, আমার মাতৃভাষা – সে বড়ই প্রিয়, বড়ই কাছের। বিদেশের কোন এক অচেনা জায়গায় এক কলি বাংলা শুনলে হৃদয় যেন জুড়িয়ে যায়। পৃথিবীর যত নতুন ভাষাই শিখি না কেন, আমার চিন্তার ভাষা, স্বপ্ন বোনার ভাষা, দুঃখ পাওয়ার ভাষা যে এখনো মাতৃভাষা, মায়ের ভাষাকে আমি ভুলি কি করে!
পৃথিবীতে কতো ভাষাই না আছে, তাঁর কতটুকুই বা খোঁজ রাখি, সত্যি বলতে মাতৃভাষারও কি খুব একটা খবর রাখি আমরা! সবাই তো আমরা ধাওয়া করে চলেছি একই ভাষা ‘ইংরেজি’র দিকে। তবে, ফ্রান্সে দেখেছি মানুষ নিজের ও অন্যের ভাষাকে খুবই মর্যাদা দেয়। এখানে দেখেছি, ইংরেজি যদি হয় ব্যবসার ভাষা, তবে হৃদয় বিনিময়ের ভাষা, উষ্ণতার ভাষা হয় মাতৃভাষা। এক দল ফরাসী ইংরেজিতে কাজের কথা বলতে বলতে কখন যে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে দেয়, নিজেরাও জানে না, সম্বিৎ ফিরলে আবার ফেরে ইংরেজিতে।
মনে হয়, পৃথিবীর নানা জায়গায় মানুষের নানা ভাষা যেন ব্যক্তি স্বাধীনতারই আরেক নাম। আর মনে হয়, নতুন ভাষা শেখাটা এতোই জীবন্ত পদ্ধতি যে মানুষ তাঁর জীবন কালে নানা ভাষা শিখেই যায়, আসলে ভাষা শেখা নয় ‘বিষয়’ শেখাটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসীরা যেমন বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়ই ফরাসী ভাষায় শেখে, তাই, তাদের যে কোন বিষয়ের প্রতি গভীরতা বেশী, জ্ঞান বেশী।
মানুষের সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বুকে কতোই না ভাষার জন্ম হয়েছে, আবার শক্তিশালী ভাষার চাপে পৃথিবীর বুক থেকে কতো ভাষা চিরতরে মুছেই গেছে। ভাষাবিদরা বলেন, প্রতি পাঁচ কিলোমিটার অন্তর মানুষের কথ্য ভাষা বদলে যায়, আর শুধু মাত্র গত শতাব্দীতে প্রায় চারশো সংখ্যালঘু ভাষা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এবং এখনো প্রতি তিন মাসে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে চলেছে। অনুমান করা হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সংখ্যালঘু ভাষা এই শতাব্দীর শেষে পুরোপুরিই লুপ্ত হয়ে যাবে – ভাবা যায়, কেউই আর ঐ সব ভাষায় চিন্তা করবে না, স্বপ্ন দেখবে না, ভালোবাসবে না, গান গাইবে না – তখন মনে হয়, পৃথিবী খুবই বৈচিত্রহীন হয়ে যাবে, নতুন দেশের নতুন ভাষা শেখার সেই রোমাঞ্চটাই যেন হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে মানুষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। আমার মাতৃভাষাও কি সেই পথে চলেছে?