April 2010, Rome, Italy
রোমান হলিডে সিনেমা দেখেছিলাম বহু আগে, রোমের অলি গলিতে ঘুরেছিলাম ইতিহাসের পাতায়। আজ রোমে এসে সিনেমা ও কল্পনার সেই সব ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম আজকের বাস্তব রোমের ছবি।
বিখ্যাত কলোসিয়ামের (Colosseum) ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে যেন শুনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সিংহের গর্জন, গ্ল্যাডিয়েটরের হুঙ্কার। কান পেতে শুনতে চাইছিলাম ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিঃশ্বাসের শব্দ, ফিস ফাস, ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ। রাজকীয় অহংকারের প্রতীকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অহং বোধকে যেন একটু তাঁতিয়ে নিচ্ছিলাম।
ছেলেবেলায় ইতিহাস বিষয়টাকে খুব নীরস বলে মনে হত, ভয় পেতাম। আজ যেন ইতিহাস বইয়ের পাতার জীবন্ত নিদর্শনের সামনে দাঁড়িয়েছি। আজ আর ভয় নয় সমীহ হচ্ছে। ইতিহাসের নিদর্শন বুকে নিয়ে, অতীত ও বর্তমান দিন বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজকের এই আধুনিক রোম।
প্রতিদিন হয়তো কয়েক কোটি ফটো ওঠানো হয় এই কলোসিয়ামের, পৃথিবীর কত কোটি মানুষের ঘরে যে কলোসিয়ামের সঙ্গে ওঠানো নিজের বাঁধানো ফটো আছে তার ইয়ত্তা নেই।
সময়টা ছিল ইস্টার, তাই কলোসিয়াম দু’টোর সময় বন্ধ করে দেওয়া হবে। আসলে এখনো এই কলোসিয়ামে অনেক প্রোগ্রাম হয়। রাতে কনসার্ট হবে এখানে তারই প্রস্তুতি চলছে। তাই তাড়াতাড়ি কলোসিয়ামের মোহ কাটিয়ে রোমের অন্য দিক আবিষ্কারের উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।
রোম যেমন একদিনে তৈরি হয়নি তেমনি রোম একদিনে দেখাও যায় না। রোমের পরিবেশে এখনো যেন ভাসে পুরনো গন্ধ, পুরনো রহস্য। ম্যাপ আমাদের পথ দেখায়। পথে দেখি অতীতের Roman Forum, পুরনো রোমের কেন্দ্র ছিল এই জায়গা।
যা কিছু ব্যবসা বানিজ্য, রাজ্য বিস্তার সবই ছিল এখানে। এখন এক ধ্বংসাবশেষ, উঁচু উঁচু কিছু থাম আর অনেক দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। রোমে আমার মনে হয় ইতিহাসের উপস্থিতির চেয়েও অনুভব বেশী। রোমান সাম্রাজ্যের অহং, উত্থান ও পতন, সৃষ্টি ও ধ্বংসের যা কিছু নিদর্শন সবই এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মানুষের শক্তির চেয়েও বেশী মহা শক্তিমান কালের শক্তি অনুভূত হয় রোমে।
শহরের একদম মধ্যে আছে Piazza Venezia। বিশাল এই স্থাপত্য ঘিরে এই শহরের প্রাণকেন্দ্র। কত নতুন ও পুরোন সিনেমায় যে এই জায়গার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই। এখানে আশেপাশে আরও অনেক ঐতিহাসিক বিল্ডিং আছে। যেমন উত্তর দিকে আছে নেপোলিয়ানের মায়ের বাড়ী, Palazzo Bonaparte, তাছাড়া আছে আঠারো শতকের বিল্ডিং Palazzetto Venezia।
কিছুক্ষণ এই বিশাল চত্তরে বসে ইতালির শহুরে জীবনের একটু আঁচ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। এখানে এই শহরের ব্যস্ততা অন্যান্য আর পাঁচটা শহরের মতোই। ইস্টারের ছুটিতে প্রচুর টুরিস্ট এখানে। রোমে এই সময়ে বেশ গরম পড়ে।
একটু একটু করে রোমের অবগুণ্ঠন খুলছে আমাদের সামনে। রাস্তা ঘাট চিনে নিচ্ছি ম্যাপে। চলে এলাম Trevi Fountain।
Trevi Fountain এর মধ্যে নেপচুন – সমুদ্র দেবতার মূর্তি, দু’পাশে সমুদ্র ঘোড়া – সমুদ্রের জোয়ার ভাঁটার প্রতীক। রোমান হলিডে সিমেমায় এই Trevi Fountain কে দেখা গেছে। এখানে পয়সা ফেলার রেওয়াজ।
Trevi Fountain এর সামনে যে রাস্তা চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম রোমান মন্দির Roman Pantheon। এখন Roman Pantheon এর মেরামত চলছে তাই কিছু অংশ ঢাকা। ভিড়, সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ি। এগিয়ে চললাম এখনো অনেক দেখার বাকি।
এবার চলে এলাম Piazza di Spagna বা Spanish Steps। আঠারো শতকে তৈরি এই সিঁড়ি Pincio Hill এর উপরে ফ্রেঞ্চ চার্চ Trinita dei Monti কে জুড়েছে। প্রতি বছর গরমের সময় এই সিঁড়িতে ফ্যাশন শো হয়। এই Spanish Steps এর রাস্তায় প্রচুর দোকান।
শেষ বিকেলের দিকে চলে গেলাম শহরের অন্য প্রান্তে বিখ্যাত রোমান স্নান ঘরের ধ্বংসাবশেষ Baths of Caracalla। রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষে সূর্যাস্ত দেখলাম। এইদিকে সন্ধ্যার এই সময়ে বিশেষ টুরিস্ট নেই, নির্জন এই ধ্বংসাবশেষে যখন সূর্যের শেষ বেলার আলো নিভে আসছিল, ধীরে ধীরে ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল, বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল মন। সব আলো নিভে আসে, সব পাখি ঘরে ফেরে, ফুরায় রোমান সাম্রাজ্যের সব লেনদেন – সামনে পড়ে থাকে সময়ের কঙ্কাল।