একটা বড় পুতুলের পেটের ভেতরে আরও একটা, তার ভেতরে আরও একটা – এই ভাবে একটা বড় পুতুলের ভেতরে একে একে সাতটা ছোট পুতুলও থাকতে পারে – আর এই আশ্চর্য পুতুলই রাশিয়ার মানুষের প্রিয় পুতুল – মাত্রিওস্কা।
রাশিয়ার এই মাত্রিওস্কা পুতুলের সবচেয়ে বড় পুতুলটি সাধারণত মহিলা হয়, ভেতরের পুতুল গুলো মহিলা বা পুরুষ হতে পারে, আর সবচেয়ে ছোট পুতুলটি এক বাচ্চা পুতুল – দেখেই মনে হয় ওরা একই পরিবারের লোকজন, সবাই রাশিয়ার নিজস্ব ট্র্যাডিশনাল নানা ধরণের পোশাকে সজ্জিত।
বড়ই মিষ্টি দেখতে নজরকারা রঙের এই পুতুলগুলোকে যখনই তুলুসের যে কোন মেলায় দেখি, চোখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। পুতুল, শুধুই বাচ্চাদের খেলার জন্যেই এই পুতুলের জন্ম – অথচ, আজ এই মাত্রিওস্কা রাশিয়ার প্রতীক, রাশিয়ার সংস্কৃতি, রাশিয়ার শিল্প, রাশিয়ার স্যুভেনির। আর সেই বিশেষ পরিচিতির জন্যে মাত্রিওস্কাকে দীর্ঘ দিন ধরে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু পথ।
কাঠের তৈরি এই পুতুল গুলোর গায়ে পোশাক গুলোকেও খুবই নিখুঁত ভাবে আঁকা হয়। শুনেছি, রাশিয়ার রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এই বাবুস্কা বা মাত্রিওস্কা পুতুল গুলোর পোশাকও পালটে যায়। সোভিয়েত আমলে রাশিয়ার রাজনৈতিক নেতার আদলেও মাত্রিওস্কা তৈরি হয়েছে – তবে, মাত্রিওস্কার পুতুলের মূল বিষয় ছিল রাশিয়ার রূপকথার চরিত্র, যে কিনা আজও রাশিয়ার ফুল লতা পাতা আঁকা উজ্জ্বল পোশাকে সাজে।
তুলুসে যে কয়েকজন রাশিয়ার মানুষ থাকে, তারা যে কোন মেলা বা উৎসব অনুষ্ঠান হলেই এই রাশিয়ান পুতুল মাত্রিওস্কার পসরা সাজিয়ে বসে – উজ্জ্বল রঙের একঝাক পুতুল গুলোকে দেখতে বেশ লাগে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাশিয়ার Abramtsevo এস্টেটে তৈরি হয়েছিল এই পুতুল, প্যারিসের বিশ্ব শিল্প মেলায় প্রথম প্রদর্শনী করার পরেই বিশ্বের চারিদিকে এই আশ্চর্য পুতুলের কথা ছড়িয়ে পড়ে – বিশ্বজয়ের উদ্দেশ্যে মাত্রিওস্কা বেড়িয়ে পড়ে।
তারপর রাশিয়ার এই মাত্রিওস্কা তৈরি রীতিমত এক ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যায়। রাশিয়ায় শুরু হয়ে যায় প্রচুর মাত্রিওস্কা তৈরির কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পড়ে এই মাত্রিওস্কার গায়েও সেই ভাঙ্গনের আঁচ পড়ে। রাশিয়ার সেই মাত্রিওস্কা তৈরিতেও ভাঁটা পড়ে যায় – তবে মাত্রিওস্কা এখন আবার নব উদ্যমে ফিরে এসেছে। মিষ্টি চেহারার পুতুলটি আবারও সবার মন জয় করে চলেছে।
যাইহোক, নতুন মাত্রিওস্কার দাম যাই হোক না কেন, তুলুসের এন্টিক বাজারে একটু পুরনো মাত্রিওস্কার দাম শুনে তো আকাশ থেকে পড়ার উপক্রম আরকি – দুই হাজার ইউরো? ফরাসী এন্টিক ডিলার মিষ্টি হেসে বলেছিল – আরও বেশী দামেরও হতে পারে, এটা কালেক্টরস আইটেম। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ের এই মাত্রিওস্কাকে তো আমি জলের দরেই বিক্রি করে দিচ্ছি। বোঝো কাণ্ড।
তুলুসে প্রতি বছর তুলুসের ক্রিসমাস মেলা কিংবা ভাষা মেলায়, এক রাশিয়ান দম্পতীকে দেখি মাত্রিওস্কা সাজিয়ে বসে – মাত্রিওস্কাকে তুলুসের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের মুখে এক তৃপ্তির আভা দেখেছিলাম, মাত্রিওস্কাকে নিয়ে যে যাই প্রশ্ন করুক না কেন – কি অসীম ধৈর্যে হাসিমুখে উত্তর দেয় দু’জনে! ওরা বলে – মাত্রিওস্কা শুধু এক খেলার পুতুল নয়, রাশিয়ার শুধু এক স্যুভেনির নয় – মাত্রিওস্কা সুখ, সম্বৃদ্ধির প্রতীক, জীবনের প্রতীক।