কোন উত্তর নেই। শার্লট ইউরোপের প্রায় ছটা ভাষা জানে। তাছাড়া, কিছুদিন হল আরবি আর উর্দু শিখছে। শার্লটের গবেষণার বিষয় হল পৃথিবীর প্রাচীনতম নানান ভাষা গুলির মধ্যে মিল ও অমিল এবং তাদের উৎস খুঁজে বের করা। এই পৃথিবীর প্রাচীন ভাষার উৎস খুঁজতে গিয়ে শার্লট কয়েকদিন আগেই অনেক প্রাচীন পুথিপত্র ঘেঁটে ইজিপ্ট থেকে ফিরেছে। ইজিপ্টের ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে ইজিপ্টের সভ্যতার সমসাময়িক আরেক সভ্যতা এবং তাদের ভাষা শার্লটের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে – ভারতের মহেঞ্জদরো হরপ্পার সভ্যতা ও ভাষা। তাছাড়া শার্লট আরও দু’টি প্রাচীন ভাষা ল্যাটিন এবং সংস্কৃতের মধ্যে মিল খোঁজার নেশায় মগ্ন। ল্যাটিন ও সংস্কৃতের মধ্যে তুলনামুলক আলোচনা করে কিছুদিন আগেই শার্লট এক নামকরা পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছে।
শার্লট ক্রমে ক্রমে ওর জানা সমস্ত ভাষায় লোকটিকে জিজ্ঞেস করল – তার নাম। লোকটা নিরুত্তর, চোখের ভাবেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না যে এই এতো গুলো ভাষার যে কোন একটা ভাষা ও বুঝতে পেরেছে।
শার্লোট মার্থার দিকে তাকিয়ে কাঁধ নাচালো। বলল – কিছুই তো বুঝতে পারছে না লোকটা।
মার্থা বলল – দেখো আরেকবার চেষ্টা করে।
যথারীতি শার্লটের সমস্ত চেষ্টা বৃথা গেলো। মার্থা অগত্যা লোকটাকে লকআপে পুরে তালা লাগিয়ে দিল, শার্লটকে বলল – চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
পথে যেতে যেতে শার্লট কোন কথা বলছিল না। লোকটার কথা মাথায় ঘুরছিল। কোন দেশের লোক, কোথা থেকে এসেছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার রোদে পোড়া তামাটে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এশিয়ার মানুষ কিংবা পূর্ব ইউরোপিয়ান।
নিজের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝ রাতে দেখা সেই জেলে বন্দী নাম গোত্রহীন লোকটার কথা ভেসে আসে শার্লটের মাথায়। কে ঐ লোকটা? কি তার পরিচয়? কোনও গুপ্তচর নাকি? এই সব নানান অদ্ভুতুড়ে ভাবনা মাথায় ঝিলিক দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। নানান কাজের ভিড়ে কিছুদিনের মধ্যে ঐ লোকটার কথা শার্লটের মাথা থেকে ঝাপসাই হয়ে যাচ্ছিল।
এক বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে, বসার ঘরে নিজের ল্যাপটপের সামনে শার্লট বসেছিল – প্রাগে এক কনফারেন্সের জন্যে পেপার তৈরি করছিল, কিছু নোট দেখছিল।
পুলিশ অফিসার মার্থার ফোন এলো – হ্যালো শার্লট। মনে আছে, সেই মাঝ রাতে ধরা পড়া লোকটার কথা? ওর কেস আদালতে উঠেছে। তোমাকে সামনের সপ্তাহের মঙ্গল বারে একবার আসতে হবে আদালতে। যদি লোকটা কথা বলে, কোন দেশের জানা যায়, তাহলে কাগজ পত্র তৈরি করে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে সেই দেশে।’’
ঝাপসা হয়ে যাওয়া নাম গোত্রহীন লোকটার চিন্তা যেন হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শার্লটের মস্তিষ্কে। মারাত্মক এক কৌতূহল বশে শার্লট রাজি হলো। ফিরে এলো, সেই ঝাপসা হয়ে যাওয়া অদ্ভুত ভাবনা গুলো – কে সে? কেন এখানে? কি করে? আরও কত নানা চিন্তা।
আসলে, দক্ষিণ ফ্রান্সের এই শান্ত নির্জন ঐতিহাসিক মফঃস্বল শহরে পর্যটক ছাড়া অন্য কোন নতুন মানুষ আসে না – পর্যটকরাও এখানে খুব একটা বেশিদিন থাকে না। পর্যটকরা এলে, ঐতিহাসিক শহরটির মাঝ বরাবর যে নদীটি বয়ে গেছে – টার্ন, সেই টার্ন নদীর বুকে নৌকো ভাসিয়ে, শহরের মিউজিয়ামের ঐতিহাসিক রহস্যে ডুব দিয়ে, লাল ইটের তৈরি দক্ষিণ ফ্রান্সের বিখ্যাত আলবি ক্যাথিড্রালের গায়ের সুক্ষ কাজ দেখে ও ধার্মিক শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে যায় নিজের দেশে।
আলবির ক্যাথিড্রালটি লাল ইটের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইটের তৈরি ক্যাথিড্রাল, তাই অনেক ধার্মিক পর্যটক শুধু আলবি ক্যাথিড্রালের টানেই এই শহরে পা রাখে। এই শহরে ইতিহাসের বুকে, ইতিহাসকে হৃদয়ে নিয়ে বাঁচে আজকের মানুষ।
শার্লট তাঁদের মধ্যে একজন – তাই বোধহয় শার্লটের পড়াশোনার বিষয়ও ইতিহাস ও পর্যটন। ও জেনে নিতে চায় এই পৃথিবীর বুকে মানুষের বেঁচে থাকার ইতিহাসের মূল মন্ত্রটিকে, পৃথিবীর ইতিহাসে ইউরোপের অবদানকে।
শার্লট বড়ই ভালোবাসে তার এই পরিষ্কার, ছিমছাম ছোট্ট শহরটিকে। এ যে তার জায়গা, তার শহর, তার জন্ম স্থান, শৈশবের খেলাঘর, কিশোরী বেলার দুরন্ত স্বপ্নের আকাশ, তরুণী বেলার স্মৃতি, যৌবনের স্বপ্ন চারণ ভূমি, তার কর্ম ভূমি।
এই শহরের মাটির সুবাস, টার্ন নদীর বুক ছুঁয়ে উঠে আসা ঠাণ্ডা বাতাস শার্লটের ফুসফুস সতেজ করে। এই শহরের প্রতিটি মানুষ তার চেনা। এই শহর শার্লটের সমস্ত হাসি কান্না, রাগ, ঘৃণা, ভালোবাসা, হার, জিত, ওর দিন রাতের যত স্বপ্ন – সবই যেন ধারণ করে নিয়েছে, সযত্নে লালন করেছে, দিয়েছে এক পরম আশ্রয়। এই শহর তার চেতনাকে জাগ্রত করেছে, চিন্তার প্রসার ঘটিয়েছে। এই শহরের ইতিহাস ও সম্বৃদ্ধির পেছনে শার্লটের পূর্ব পুরুষদেরও প্রচুর অবদান ছিল, শার্লট ও চায় সে এই শহরে থেকে সেই সম্বৃদ্ধির পথে পা বাড়াতে।
আলবি শহরের চারিদিকের প্রচুর গাছ, প্রচুর সবুজ, টার্ন নদীর ধার ঘেঁসে সবুজ পার্ক, মাঠ এই শহরের ফুসফুস। ধূসর শীত কেটে গিয়ে যখন বসন্ত আসে, সোনালি রোদ এই লাল ইটের শহরের উপরে লুটিয়ে পড়ে – এক অদ্ভুত মায়াবী ছবি তৈরি হয়। সবুজ গাছ গুলোর পাতা গুলোয় সব রঙ লাগে – হলদে, লাল, কমলা হয়ে যায় চারিদিক।
এখানে সামারে চারিদিকের প্রকৃতিতে যেমন এক স্বপ্ন রঙিন রঙের মারকাটারি খেলা চলে, তেমনি শীতে হয়ে ওঠে ধূসর। সামারের শেষ বিকেলে আলবির উদার পশ্চিম আকাশ যেন লাইল্যাক শেডের আভায় আঁকা হয়, লাইল্যাক শেডের পেছনে উঁকি দেয় হালকা কমলা রঙের পোঁচ।
উজ্জ্বল সোনালি দিনে এখানের প্রকৃতির রূপ যেন এক শিল্পীর অদ্ভুত সুন্দর এক ক্যানভাস বলে মনে হয়। দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রকৃতি তো বহু নামী ও কাল জয়ী শিল্পীর তুলি ধরার প্রেরণা। এখানের প্রকৃতির মন মোহিনী রূপে মুগ্ধ হয়ে এক অদ্ভুত ভালো লাগায় শার্লটের মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিংবা হাজার হাজার বছর এই সোনালি আলবির বুকে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, নিজেকে প্রকাশ করতে, বিকশিত করতে ইচ্ছে করে। কিংবা, ওর বয়সই এমন যে পৃথিবীকে ভালো লাগারই বয়স।
ছুটির সোনালি সকালে কানে আই ফোনের গান শুনতে শুনতে শার্লট দৌড়তে যায়। নদীর ধারে বনের রাস্তা দিয়ে, সবুজ পার্কের ধারে ঘণ্টা খানেক দৌড়ে ফিরে আসে – সবুজ পথে এই দৌড় তার জীবনী শক্তির উৎস।
এখানে অক্টোবরের শুরুতে চারিদিকের গাছ গুলোর লাল হলুদ শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে পার্কের পথ, বনের পথ গুলোকে যেন সোনালি চাদরে মুড়িয়ে দেয়। দৌড়ের তালে তালে শুকনো পাতায় খস খস শব্দ করে দৌড়ে চলে শার্লট, সব মেদ ঝরে যায়, তরতাজা হয়ে ওঠে। বনের কাঠবেরালিরা সরে যায় শার্লটের পায়ের আওয়াজে – অপূর্ব এক নিশ্চিন্ত প্রশান্তির জীবন শার্লটের।
বাইরের পৃথিবীর ক্ষয় ক্ষতি, রক্ত ক্ষয়, হানাহানি, মারামারি এই শহরের শান্তিকে যেন কিছুতেই বিঘ্নিত করতে পারে না। এখানে সবার জীবন নিস্তরঙ্গ অপার এক শান্তির কুশনে মোড়ানো – আর সবাই সেই ভাবে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনেই অভ্যস্ত। ছোট্ট এক অনিয়মেই এখানের মানুষের জীবন আন্দোলিত হয়। বহু আগে থেকে, রোমান যুগের যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে শুরু করে, এখানের মানুষ দু’ দু’টো বিশ্ব যুদ্ধ, রক্ত খরচ, হানাহানি, মারামারি দেখে নিয়েছে, জীবন দিয়ে অনুভব করেছে ক্ষয় ক্ষতির ব্যথা। তারই গল্প আজও ফেরে এখানের মানুষের মুখে মুখে।
হিটলারের ডাহাও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের অত্যাচারের হাত থেকে ভাগ্য বলে বেঁচে ফিরেছে এই শহরেরই কয়েক জন – আজ তারা বৃদ্ধ, জীবনের শেষ প্রান্তে। কিন্তু, সেই আতঙ্কের কথা, অত্যাচারের কথা, ক্ষয় ক্ষতির কথা আজও ওরা স্মরণ করে। পরবর্তী প্রজন্মকে শুনিয়ে দিয়ে যায় সেই দুঃসহ অত্যাচারের কাহিনী। তাই ওরা এখন চায় অপার শান্তির বাতাবরণ।
এখানে সবাই সবাইকে চেনে, সবার জীবনের গল্প সবাই জানে। এই শহরকে পুরোপুরি ফরাসী শহরই বলা যায়। প্রাচীন ফরাসী সংস্কৃতির সেই নির্জন নস্টালজিক সৃষ্টিশীল পরিবেশ এখনো এই শহরের বাতাসে বর্তমান। অন্যান্য জাতি ধর্মের মানুষ এখনো এই শহরে বসবাস করে না বললেই চলে। বহু পুরনো এই ঐতিহাসিক শহরের বাসিন্দারা প্রায় চার পাঁচ পুরুষ ধরে বসবাস করছে। তাই, অদ্ভুত এক নতুন মানুষের আগমন আলোড়নহীন আলবি শহরের বুকে বেশ আলোড়নই তোলে। অনেকেই জানতে চায় ঐ মানুষটার বিষয়ে। এমনকি, শার্লট দেখে স্থানীয় খবরের কাগজেও লোকটির ব্যাপারে ছোট্ট করে খবর ছেপেছে।
আদালতে লোকটা কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। দাড়ি গোঁপের জঙ্গলের ভেতর থেকে বোবা চোখ দু’টো দিয়ে তাকিয়ে ছিল বোবা দৃষ্টিতে। আদালত রায় দিল – চিকিৎসা করে জেলে ঢুকিয়ে দিতে। লোকটাকে হাসপাতালে পাঠানো হল।
আদালত থেকে ফিরে এসে এখন নিজের জীবনের নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই ঐ লোকটার বোবা চোখ দু’টো ভেসে আসছিল শার্লটের মানসচক্ষে। শার্লটের মাথা থেকে কিছুতেই যেন ঐ লোকটার ব্যাপারে চিন্তাটা যাচ্ছিল না। এক শনিবারে শার্লট হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে লোকটার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইল। ডাক্তার জানালো, সারা শরীরে নানা রকম আঘাতের চিহ্ন। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন। হয়তো, দীর্ঘদিন ধরে অনাহারে, আঘাতে লোকটার সাময়িক বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে। লোকটা বোবা নয়, বোবার কোন লক্ষণ নেই। তবে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, হয়তো চিকিৎসা করলে সেরে যাবে।
চলবে