দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্ষুদ্র জনপদ আলবি। টার্ন নদী বয়ে চলেছে এই প্রাচীন ছোট্ট শহরের মাঝ বরাবর। সহস্রাব্দ প্রাচীন এই নগরী একদিন ছিল ব্রোঞ্জ যুগের বাসিন্দাদের। জানুয়ারির শীতের রাতে ঘন কুয়াশা আর ইতিহাসের চাদর জড়িয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে আলবি। শীতের রাত এখানে দীর্ঘ। সন্ধ্যে থেকেই রাস্তা তাই জন মানব শূন্য হয়ে পড়ে।
শার্লট আজ খুব ক্লান্ত, সারাদিন খুব ধকল গেছে, তাই একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল, ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের বিরক্তিকর আওয়াজে। রাত না দিন, প্রথমে ঠাহর করতে পারে নি শার্লট। ঘুম চোখে মাথার কাছের আলো জ্বালিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল – রাত পৌনে বারোটা। এই সময় কে ফোন করল? হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মোবাইলের ছোট পর্দায় চোখ রাখল। নম্বর অচেনা। একটু চিন্তা করে দ্বিধা ভরে মোবাইলের সবুজ বোতাম টিপে বলল – হ্যালো।
ঐ পাশে এক ভদ্রমহিলার গলা – আমি শার্লটের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
বলছি – শার্লট শান্ত শীতল গলায় উত্তর দেয়।
আমি ফ্রান্স পুলিশ থেকে মার্থা বলছি। তুমি কি একবার এখানে আমাদের অফিসে আসতে পারবে?
কেন? – শার্লট খুবই অবাক হয়, আকাশ থেকে পড়ে। এই অসময়ে পুলিশের ফোন বেশ অস্বাভাবিক।
দেখো আমরা একজন মানুষকে গ্রেফতার করেছি ও ফ্রেঞ্চ ভাষা বুঝতে পারছে না। তুমি যদি আমাদের হয়ে একটু অনুবাদ করে দাও – মার্থা যেন গলার স্বর একটু নরম করার চেষ্টা করে।
ফ্রেঞ্চ পুলিশরা সাধারণত ইংরেজি জানে না, বলে না, ফ্রান্সের সরকারী ও জনসাধারণের ভাষা ফ্রেঞ্চ। তাছাড়া, শুধু ফ্রান্স বলে নয় ইউরোপের প্রতিটি দেশের নিজস্ব স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাষা আছে। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন থেকে ফ্রান্স মোটামুটি কিছুটা রেহাই পেয়েছে।
আমার মোবাইল নম্বর কি করে, কোথা থেকে পেলেন? – শার্লট একটু বিরক্তি ভরে প্রশ্ন করল।
এই ছোট্ট জায়গায় তুমিই একমাত্র কয়েকটা ভাষা জানো, তুমি ট্যুরিজম নিয়ে পড়াশোনা করেছ, তাছাড়া তুমি যার কাছে পৃথিবীর পুরনো ভাষা নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ করছ, সেই ভদ্রলোককে আমার বস চেনেন। এই কেসে উনিই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। আমি গাড়ি নিয়ে তোমার বাড়ীর গেটে অপেক্ষা করবো, ঠিক দশ মিনিট পরে।– মার্থা বলল।
অগত্যা, শার্লট মোটা কোট আর জিন্স গায়ে চাপিয়ে তৈরি হয়ে নিল। গেটের সামনে গাড়ির মৃদু আওয়াজ শোণা গেল, শার্লোট বেরিয়ে এলো। গাড়ি চালাচ্ছে মার্থা। গলার স্বর শুনে শার্লট ভেবেছিল, মার্থা বুঝি এক মধ্যবয়স্কা বদরাগী পুলিশ অফিসার হবে, কিন্তু না, মার্থা খুবই সুন্দরী। অনায়াসে কোন ছায়াছবির নায়িকা হতে পারতো মার্থা। অবশ্য শার্লটও সুশ্রী, যদিও একটু মোটার ধাত আছে তবে নিয়মিত জগিং করে শার্লট নিজেকে সুগঠিত রাখে।
মার্থা গাড়ি চালাতে চালাতে, ঐ গ্রেফতার হওয়া লোকটার সম্পূর্ণ বর্ণনা দিল । লোকটার শরীর থেকে বাজে এক গন্ধ বেরোচ্ছিল, এক মুখ দাড়ি গোঁফের জঙ্গলে আসল মুখ বোঝাই যায় না। কোন কথাই বলে নি। শুধু, দু’হাত বুকের সামনে ধরে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। চোখ দু’টির মধ্যেও কেমন নির্বোধ ভাব, কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না কোন দেশের মানুষ। সঙ্গে কোন কাগজ পত্রও নেই – যা থেকে মানুষটির পরিচয় জানা যাবে। মানুষটা কোন ভাষায় কথা বলতে পারে, সেটাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তাই অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মত শার্লটকে দিয়ে একবার চেষ্টা করা আর কি! জেলে তো রাখাই যায় লোকটাকে, কিন্তু, ফ্রান্সে জেলে রাখার আগেও অনেক নিয়ম কানুন আছে – লোকটার কোন অপরাধের ইতিহাস আছে কিনা, কোন সংক্রামক রোগ আছে কিনা, এই সব যাচাই করে তবেই জেলে ঢোকাতে হয়। কড়া নিয়ম ফ্রান্সের – এখানে যা পুলিশকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেই হয়।
শার্লট বলল – আমার কাছে তো অনুবাদকের পারমিশন নেই।
আমি আজ রাতেই তোমাকে অনুবাদকের পারমিশন বানিয়ে দেবো – স্টিয়ারিং এ হাত রেখে, মার্থা রাস্তার দিকে চোখ রেখে বলল।
লোকটাকে দেখে সত্যি অদ্ভুত লাগল শার্লটের। মাথা নিচু করে দুই হাত বুকের কাছে নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে।
শার্লটের হাতে সরকারী অনুবাদকের এক অনুমদন ধরিয়ে দিল মার্থা। শার্লট লোকটাকে জিজ্ঞেস করল ইংরেজিতে – তোমার নাম কি? কোথা থেকে এসেছ?
চলবে