রামুর কথা (Short Story)

লিখেছেন – মৈনাল পর্নক

রামুর মতে সবচেয়ে বিচ্ছিরী জায়গা হচ্ছে – সদর ঘাট। একজন ভদ্রলোক রংপুরে একটা চৌকি নিয়ে যেতে বলেছেন, ভয়ে ভয়ে চলতে থাকা রামু লক্ষ্য করল, সামনে এগিয়ে আসা একজন ট্রাফিক পুলিশ ডান হাত কপালে চেপে ধরে, পোকা তাড়ানোর মত কি এক ভঙ্গি করল। তারপর, থেমে গিয়ে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। এমন উদাসী পুলিশ রামু প্রথম দেখল। অন্যদিন হলে, এই সময়ে, ট্র্যাফিক পুলিশ কম সে কম দশ টাকা আদায় করেই ছাড়ত। রামুর পকেটে আজ কানাকড়িও ছিল না, মনে মনে ভাগ্য ভালো ভেবে, রামু পগার-পার।

রামু নামের সরল সোজা লোকটা হল ঠ্যালাওয়ালা। বিনা লাইসেন্সের ঠ্যালা চালিয়ে, রাস্তাঘাটে পুলিশের গুঁতো, দামি গাড়ির চোখ রাঙ্গানি ইত্যাদির চমৎকার ব্যবস্থাপনা মেনে নিয়ে সে বেশ সুখেই ঘর সংসার করছিল। ঘরে তার ছয় পেট, তাই তার ঘরে একবেলা ছিল পান্তা ও আরেকবেলা ছিল ভাতের ভাপ। তবুও সে ঠ্যালা চালাতো, আর আপন সুখে বাপ ঠাকুরদার সুর দেওয়া গান গাইতো।

সেবার পুজোর আগে শিব কৈলাস থেকে বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে কেনাকাটি করতে বেরুলেন। আসামের বরাক উপত্যকাতে বেশ পুজো পার্বণ হয় বলে তিনি শিলচরেই এসেছিলেন। জানিগঞ্জে বিস্তর জিনিসপত্র কিনে তিনি যখন সে গুলো ‘দিব্যরথ’ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবেন, তা যেন শিবের কাছে অসাধ্য বলে মনে হচ্ছিল।

ঠিক এমনি এক সময়ে শিবের সামনে দিয়ে রামু তার ঠ্যালা নিয়ে যাচ্ছিল। একটু আগেই রামুর ঠ্যালা রিক্সার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল, তাই রিক্সাওয়ালার কাছে বিস্তর গালাগালি খেয়ে রামু যেন একটু ন্যাতানো।

শিব বললেন – ভাই, রামু, জিনিসগুলো একটু মালুগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেবে?

অর্থাৎ শিব তাঁর ‘দিব্যরথ’ রেখেছিলেন – মালুগ্রামে।

অচেনা অজানা এক লোকের মুখে নিজের নাম শুনে কে না চমকায়? কিন্তু, নিখিল বিশ্ব খেটে খাওয়া লোকেদের সংসারে চিন্তা করার মতো, কিংবা চমকানোর মতো আলসেমি নিয়মবিরুদ্ধ কাজ ছিল। তাই একটু নেংচে নেংচে রামু মালগুলো মালুগ্রামের মেলা রোডে ভৈরববাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে দিল।

সকালে রামু বেরিয়েছিল – সাতটায়। চা ছাড়া পেটে কিছুই পড়ে নি। জিভ খানা ঝুলে পড়ছিল, কোনওরকমে ভেতরে চালান করে দিয়ে রামু বলল – পনেরো টাকা।

লোকটাকে দেখে শিবের কষ্টই হচ্ছিল। কিন্তু যমের লেখা ‘মর্ত্য সহায়িকা’তে বলা আছে – বার্গেনিং করার কথা। তাই, বাধ্য হয়ে শিব বলে উঠলেন – উঁহু, আমি সাড়ে সাত টাকা দেবো।

রামুর চোখ কপালে উঠল। বলে কি লোকটা! পোশাক আশাক দেখে তো ভদ্র বাড়ির মনে হচ্ছে। গুণ্ডা বলে তো মনে হয় না! পাগল নয়তো? পাগলরাও তো এরকম বলে না – ওরা হয় দেয়, নয়তো দেয়ই না।

রামু বললে – বাবু শিলচরের খোয়া ওঠা রাস্তাতে যতটুকু পথ এলাম, ততটুকুতে একটা নতুন চটি হাফ ক্ষয় হয়ে যায়। কেন এরকম করছেন? দিন না পনেরো টাকা – গরীব মানুষ বাবু।

মানবিকতার চরম নিদর্শন, আলাভোলা শিব নিজের ফর্মে ফিরে এসেছেন। বললেন – বাছা রামু। আমি তোমার দুঃখে কাতর হয়েছি। বল তুমি কি চাও? যে কোন বর চাও – কিন্তু, খেয়াল রেখো নিয়ম মেনে, মাত্র তিনটে বর।

রামুর এতক্ষণে মনে হল – যেন সামনের লোকটাকে চেনা যাচ্ছে। সকাল সকাল কোর্টের সামনে ডিউটি দেওয়া পাগলটা! অবিকল!

রামু নিজের কপালে দুই তিন থাবা মারলো – পোড়া কপাল, পাগলের মাল বয়ে এনেছে এতদূর!

রাগের চোটে রামু, সামনে ডাঁই করা প্যাকেট গুলো থেকে একটা তুলে নিয়ে চলতে শুরু করল, যাই থাকুক ভেতরে, কাজে দেবে।

বর দিয়ে গরীবের কিছু উন্নতি করি – এই ভেবে শিব বললেন – যাও রামু, এই বর দিলাম, যে কেউই এখন তোমায় দেখলে স্যালুট ঠুকবে। রামুর কানে যদিও শিবের এই আশীর্বাদের ছিটেফোঁটাও আসে নি।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Uncategorized and tagged , . Bookmark the permalink.

2 Responses to রামুর কথা (Short Story)

  1. Javed Ahmed বলেছেন:

    গল্পটা খুভ ভালো লাগল পড়ে ।

  2. Amvines বলেছেন:

    প্রিয় এডমিন, আপনার গোল্পটি পড়ে খুব ভাল লাগল। এটি খুবই সুন্দর একটি গল্প । পরে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান