পূজো নাকি নস্টালজিয়া

পূজো যে এসে গেল জানিস? খবর রাখিস? মহালয়া চলে গেল জানিস? কত বছর পূজোয় বাড়ি আসিস নি বল তো – মায়ের প্রশ্নে মনে হল সত্যি তো কত বছর হয়ে গেল আমার সেই ছেলেবেলার পূজো থেকে দূরে, বহু দূরে চলে এসেছি – বুঝতেই পারি নি।

বললাম – না মা, এক্কেবারেই বুঝতে পারছি না।

বর্তমান সময়ে এতোটাই ব্যস্ত, এতটাই মগ্ন কখন রোদের ছায়া দীর্ঘ হল, কখন শিউলির দল ফুটে সবুজ ঘাসে শরতের আলপনা এঁকে দিল, দেবীর আগমনের জন্যে শরত আকাশের পুঞ্জ মেঘ কেমন সুসজ্জিত হয়ে উঠল – প্রকৃতি ঠিকই মায়ের আসার আনন্দে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে – কিন্তু তা দেখার যেন সময়ই পাই নি।    

তাই তো এখন হঠাৎ চোখ মেলে দেখি, শরত এসেছে, রোদের রং-এ ফিকে হলুদের আভা, রোদের ছায়া দীর্ঘ, বাতাসে শিরশিরে ঠাণ্ডা এক অনুভূতি – আমার বেলকনির ফুল গাছে দেখি ফুল ফুটে রয়েছে – কিন্তু এ যে পূজো আসার ইঙ্গিত তা যে এক্কেবারেই ভুলে গেছি, মা।

মনে পড়ে যায় পুরনো সব পুজোর কথা, ছেলেবেলার পুজোর কথা, সেই রোমাঞ্চের কথা, সেই মানুষ গুলোর কথা – যারা আমার জীবন জুড়ে ছিল – পুজো আমার কাছে যতটা বর্তমানের ঠিক ততটাই যেন ফেলে আসা দিনগুলোর। ছেলেবেলায় শিউলি ফুল তুলে পুজো মণ্ডপে সেই ভোর ভোর শিশির ভেজা অনুভূতি এক নিমেষের জন্যে আমাকে ছুঁয়ে যায়।

এক একটা ছবি, এক একটা টুকরো কথার স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে। দেবী মায়ের সামনে সপ্তমী সন্ধ্যার আরতির ধূপ ধুনোর ধোঁয়ার আয়োজন চলেছে। ধীরে ধীরে আরতির ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে মায়ের মুখ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছি ভিড়ের মধ্যে – টুকরো কথা ভেসে আসে কানে।

কেউ একজন বলল – আমার কাছে পূজো মানে নস্টালজিয়া।

সত্যিই তো – মনে হল, পূজো যতটা না বর্তমানের আড়ম্বর তার চেয়েও বেশী অতীতের স্মৃতির আনাগোনা। আমার সেই ভালোবাসার মানুষ যারা আজ আর নেই, রয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতি, তাঁদের সঙ্গে কাটানো পূজোর স্মৃতিরা সব ভির করে আসে মনে। ছেলেবেলায় কি ভাবে পূজো দেখা হত, কি ভাবে নতুন জামাকাপড়ের কোরা গন্ধে রোমাঞ্চ হত – আজও যেন চোখ বুজলেই সেই সময়টাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারি, সেই প্রিয় মানুষ গুলোর উষ্ণতাকে অনুভব করতে পারি।

টুকরো কথা কানে আসে

– এই শাড়িটি আমার বাবার দেওয়া শেষ উপহার।

– আমার কাছে পুজো মানে নস্টালজিয়া

– এবার পুজোয় বাড়ি ফাঁকা, আমার ভালো লাগছে না। আমার ছেলে দূরে চলে গেছে  

মনে হয় – প্রতি পুজোতে মানুষ কি একটু একটু করে একাকী হয়? কাছের মানুষরা কি একটু করে দূরে চলে যেতে থাকে?

এক এক জনের কাছে পুজো এক এক রকম। কারোর কারোর কাছে কোন কোন বছরের পূজো থাকে নিঃস্বতার এক অধ্যায়, সব হারানোর তীব্র এক ব্যথা।

কারোর কাছে থাকে সব পাওয়ার এক উৎসব, কারোর কাছে বিষণ্ণ এক শীতলতা –

তবুও পুজো আসে, আলোয় সাজে সংসার, নতুনের গন্ধে মাতে কয়েকটি দিন – ভালো লাগে। জীবনের পথে মানুষ এগিয়ে চলে, আবার পুজো আসে। ফিরে ফিরে আসে।  

সব পূজোয় তো আর ঘরে ফেরা হয় না, তাই মনটাকে নিয়েই স্মৃতির পাতার পূজোর দিন গুলোয় উঁকি মারি। টাইম মেশিনে চড়ে মন পাড়ি দেয় অতীত সময়ে।

তাই, আরতির ধোঁয়ার গন্ধে এক নিমেষেই সময়ের চাকা যেন পিছনের দিকে ঘুরতে শুরু করে। ধোঁয়ার আড়ালে মাকে প্রথম দেখার সেই চিরন্তন বিস্ময়ের সামনে এসে দাঁড়াই।   মা গো আজও যে এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে সেই আমিটি বার বার তোমার সামনে এসে দাঁড়ায়।  

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Memory-Lane and tagged , , . Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান