নানা রঙের অদ্ভুত সুন্দর এই টিউলিপ ফুল, কিন্তু, এই সুন্দর ফুলটিই যে এক বড় “economic bubble” এর সৃষ্টি করে দিতে পারে তা এক্কেবারেই জানা ছিল না। বসন্তের শুরুতেই ইউরোপের চারিদিকে প্রকৃতির কোলে রঙের পোঁচ দেখে, মনে হয় প্রকৃতির ভালোবাসা, ধৈর্য, শিল্প, হাজার রং, স্বপ্ন, রোমান্স, মাধুর্যের আরেক নাম টিউলিপ (Tulip)। কিন্তু, এই অদ্ভুত সুন্দর ফুলই যে ষোল শতাব্দীতে কতো মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে, জন্ম দিয়েছে অর্থনীতির এক নতুন বিষয় তা কে জানত? দীর্ঘ শীতে কঠিন ঘুমে মাটির নীচে অচেতন হয়ে থাকে টিউলিপের বাল্ব গুলো। পেঁয়াজের মতো সাধারণ দেখতে বাল্ব গুলোর মধ্যে যে হাজার রঙের ফুল ফোটানোর মোহময়ী সম্ভাবনা আছে, কল্পনা করা যায় না। অপেক্ষা করতে হয় বসন্তের জন্যে, বসন্তে নানা রঙের বড় বড় পাপড়ির এই টিউলিপের মোহে যেন পুরো ইউরোপ মেতে ওঠে। চারিদিকের পার্কে, বাগানে আলো হয়ে ফুটে ওঠে নানা রঙের টিউলিপ। কত প্রজাতির, কত হরেক রঙের টিউলিপ যে ফুটে ওঠে, কি বলি।
যেহেতু সঠিক তাপমাত্রার উপরে এই ফুলের ফুটে ওঠা নির্ভর করে তাই ফেব্রুয়ারির মাঝামঝি থেকে শুরু করে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইউরোপের নানা দিকে যেখানেই গেছি এই ফুলের দেখা পেয়েছি। কোথাও আগে ফুটে গিয়ে ঝড়ে যায়, আবার কোথাও দেরীতে দেখা দেয়। যত উত্তরের দিকে যাওয়া যায় প্রকৃতি যেন টিউলিপের রঙে আরও মেতে ওঠে।
টিউলিপের জন্যে বিখ্যাত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুল বাগান, ন্যাদারল্যান্ডের Keukenhof বাগান। প্রতি বছর হল্যান্ডের বিখ্যাত টিউলিপ ফ্যাস্টিভ্যেলের জন্যে মার্চ থেকে মে মাসের প্রথম পর্যন্ত এই বাগান সাজে টিউলিপের চাদরে, বিশাল বাগানের প্রায় সমস্ত সবুজ নানা রঙের টিউলিপের বিছানায় ঢাকা পড়ে যায়, পৃথিবীর নানা দিকের মানুষ শুধু টিউলিপ দেখতেই ভিড় করে এই বাগানে।
এমনকি, হল্যান্ডের অনেক গ্রামে শুরু হয় টিউলিপ ট্যুরিজম। টিউলিপ বাগানের ভেতরে ক্যাম্পিং করে রাত কাটানো যায়, কিংবা টিউলিপ বাগানের ভেতরে হোটেলে থাকা যায়, দু’ চোখ ভরে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত টিউলিপ চাষের জমি, নানা রঙের টিউলিপ চোখে লাগিয়ে দেয় রং-এর মোহ। সেই সময় টিউলিপের পরিচর্যা ও তার ফুটে ওঠাকে ঘিরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে সেখানের স্থানীয় জন সাধারণ। তবে টিউলিপের সর্বাঙ্গীণ ফুটে ওঠা দেখতে হলে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে সঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছনোটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, খুব বেশী আগে চলে গেলে আবার শুধু কুঁড়িই দেখা যায়, আর এক দিন দেরি হলে একটা টিউলিপেরও দেখা পাওয়া যায় না, সমস্ত টিউলিপ কেটে ইউরোপের বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। নানান ফুল বাজারে চলে আসে হল্যান্ডের বিখ্যাত বাগানের টিউলিপ।
অটোমানের রাজত্বে এই টিউলিপের চাষ হত, ষোল শতাব্দীতে ইউরোপে প্রথম টিউলিপের পদার্পণ হয় ভিয়েনায়। আর ডাচ স্বর্ণযুগে এই আশ্চর্য ফুলের সৌন্দর্যের কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপে। তুলনামূলক একটু বড় পাপড়ির উজ্জ্বল রঙের এই ফুল ও এর সৌন্দর্য তার আগে কখনো ইউরোপ দেখে নি। তখনকার নানা শিল্পীর তুলিতে, নানা চিত্রে, তেল রঙে ধরা পড়ে টিউলিপের অপূর্ব সৌন্দর্য। ডাচদের মধ্যে টিউলিপকে ঘিরে সৃষ্টি হয় এক মোহ।
বড়লোকদের মধ্যে এই ফুলের প্রতি এক আকর্ষণ তৈরি হয়, সবাই চায় নিজের বাগানে টিউলিপ ফোঁটাতে – তাই টিউলিপের অর্থনৈতিক মূল্য বাড়তে থাকে। ডাচ স্বর্ণযুগের সম্বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডাচ লোকেরা এই ফুলের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যায়, ডাচ বড় লোকদের মধ্যে এক নতুন ব্যবসার সূত্রপাত হয় – টিউলিপ চাষ ও বিক্রি।
টিউলিপের চাহিদা দিনে দিনে এতো বেড়ে গেলো যে, ডাচ সমাজের সাধারণ লোকেরাও নিজেদের কাজ ছেড়ে টিউলিপের ব্যবসায় নেমে পড়ল, শুরু হল টিউলিপ বাল্বের নিলাম। টিউলিপের দাম হয়ে পড়ল আকাশ ছোঁয়া, এমনকি ষোল শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক একটা টিউলিপ বাল্বের দাম সেই সময়ের অ্যামস্টারডামের একটা দামী বাড়ীর দামের চেয়েও বেশী হয়ে দাঁড়াল।
সাধারণ ডাচ লোকেরা পাগলের মতো নিজেদের বাড়ী ঘর বিক্রি করে বিনিয়োগ করতে শুরু করল ঐ টিউলিপ বাল্বের ব্যবসায়, ব্যপার এমন হয়ে দাঁড়ালো যে আসল টিউলিপ বিক্রি করার জায়গায় টিউলিপের দলিল বিক্রি হতে শুরু হয়ে গেল, আর সেই দলিল নানা জনের হাত ঘুরে তার দাম হয়ে পড়ল আকাশ ছোঁয়া। যখন টিউলিপের দলিলের দাম মানুষের হাত ঘুরে ঘুরে আকাশ ছোঁয়া হয়ে পড়েছে, টিউলিপ বাল্বরা কিন্তু তখনও মাটির নীচে। এমনও হয়েছে যে একটা টিউলিপ দলিল দিনে দশ বার হাতবদল হয়ে দাম বেড়ে গেছে। সেই সময় পুরো ডাচ সমাজ এক Tulip mania য় অবশ হয়ে টিউলিপ বিনিয়োগে মেতে উঠেছিল।
তারপর যা হয় আর কি, বাজারে এতোই টিউলিপ উৎপাদন হল যে টিউলিপের দাম এসে দাঁড়ালো কানাকড়ির মূল্যে – টিউলিপের ফুলে ফেঁপে ওঠা সেই বিশাল বুদ্বুদটি ফেটে গেল। দেখা গেল, আসলে টিউলিপ এতো দুর্মূল্য, প্রতিদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত দরকারি জিনিস বা দুর্লভ বস্তু ছিল না। সাধারণ মানুষই অহেতুক ভাবে এর দাম বাড়িয়েছিল, সবাই আক্রান্ত ছিল Tulip mania য়। সেই সময় অনেক সাধারণ মানুষ এই Tulip mania য় সর্বস্বান্ত হয়েছিল। অর্থনীতিতে এক নতুন বিষয় যোগ হল Tulip mania বা Tulip bubble। বর্তমান যুগ যত bubble দেখেছে Stock market bubble, real estate bubble, dot com bubble তার মধ্যে Tulip bubble ই হল পথিকৃৎ। অর্থনীতির ইতিহাসে প্রথম নথিভুক্ত অর্থনৈতিক বুদবুদ।
মনে হয়, পৃথিবীতে যতই অর্থনৈতিক bubble তৈরি হয়েছে সবই শুরু হয়েছে এক পাগলামি বা ম্যানিয়া থেকে। সমাজের কিছু লোক যখন লাভবান হয়, পেছনে ধাওয়া করে উন্মত্ত জনতা। সহজ লাভের আশায় ডুবিয়ে দেয় নিজের শেষ সঞ্চয় টুকু। তাছাড়া মনে হয়, এই ধরণের বুদবুদ তৈরির পেছনে কোথাও না কোথাও মানুষের পূর্বপুরুষের অনুকরণ প্রবৃত্তি কাজ করে, আর পূর্বপুরুষের সেই অনুকরণ প্রবৃত্তিই তাঁকে সর্বস্বান্ত করে। তখন মানুষ ভুলে যায় কি তার দরকার, কিসে তার লাভ লোকসান, কি তার কাজ। সে তখন ভুলে যায় – সে মানুষ। আর দায়ী করে আপন মনে, নানা রঙে ফুটে ওঠা, বাগান আলো করা সুন্দর এই টিউলিপ ফুলগুলোকে।
Very nice photos ….
Thank you for the appreciation….
Tulips always look so magnificent when planted en masse.
True. They are beautiful indeed. Color of nature. Thanks.