এক যাযাবর লক্ষ্যবিহীন (বড়গল্প – চার )

(বড়গল্প – তিন )

একই ছন্দে চলতে থাকা ট্রেনের দুলুনিতে দুলতে দুলতে বিষাক্ত তিক্ত মনে লোকটা ভাবছে – এই যে, গ্রীসে এতো স্ট্রবেরি উৎপাদন হয় যায় কোথায়? ইউরোপিয়ান বড় লোকদের পেটে! আর আমরা দিন রাত খেটে এক পয়সাও হাতে পাই না। আমাদের ঘাম রক্তেই বোধহয় স্ট্রবেরির রঙ লাল হয়েছে।

মানোলাদার সেই স্ট্রবেরি ফার্মে যে দেড়শো জন মানুষ কাজ করতো, তারা সবাই ছিল তৃতীয় বিশ্বের লোক – অনেকের সঙ্গেই লোকটার বন্ধুত্ব হয়েছিল – লোকটা কিন্তু কখনো নিজের দেশের নাম বলতে চাইতো না। সেখানে, সবাই যা চাইতো, তা হল – মুক্তি।

সেই স্ট্রবেরি ফার্ম থেকে পালিয়ে ইউরোপের অন্য কোথাও চলে যেতে চাইতো সবাই, কিন্তু কেউই নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইতো না। কি অমানুষিক খাটুনী ছিল সেখানে। ফার্মের চারিদিকে ছিল তারের উঁচু জাল, আর বন্দুক নিয়ে গ্রীক মালিকের পাহারাদাররা পাহারা দিত, কেউ যাতে পালাতে না পারে – সেই দিকে ওদের ছিল কড়া নজর, সঙ্গে দানব আকারের কুকুরও থাকতো, পালাতে চাইলে কুকুর লেলিয়ে দিতেও দ্বিধা করতো না ঐ পাহারাদাররা। নানান অসম্ভব পরিকল্পনা করতে করতে, একদিন ওরা কয়েকজন পালানোর সুযোগ পেয়ে গেল।

স্ট্রবেরি পেকে গেলে, মাঠ থেকে তোলার মরশুম এলে, ফার্মের ভেতরে যে সমস্ত ট্রাক স্ট্রবেরির বাক্স নিতে আসতো, কয়েকজন দল বেঁধে সেই রমক কয়েকটা স্ট্রবেরির ট্রাকে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এথেন্স চলে এসেছিল।

এথেন্সে এসে ওর জীবন স্ট্রবেরি ফার্মের অমানুষিক পরিশ্রম থেকে মুক্তি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু, আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। কত দিন গেছে, এক বেলা খেতে পায় নি। কত দিন ভিক্ষার চেষ্টা করেও পারে নি। রাস্তার পাশে বসে হাত পাততে খুবই সংকোচ হত, কিন্তু, পেটের দায়ে অবশেষে হাত পেতেছিল। দিনের শেষে দু’ ইউরোও হয় নি, যে পেট ভরে খাবার খেতে পাবে – বিদেশী ভিখারিকে কে ভিক্ষা দেবে? কোন কোন দিন শহরের চার্চে খাবার বিতরণ হোতো, সেখানে প্রচুর লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে খাবার পেতো কোন দিন – সে দিন একটু পেট ভরে খাবার খেত।

এথেন্সে এসেও ওর কয়েক জন পথের ভিখারি বন্ধু জুটেছিল। তারাও তৃতীয় বিশ্বের যুদ্ধ, অনাহার নিপীড়িত মানুষ, প্রথম বিশ্বের কাছে আশ্রয় প্রার্থী।

এথেন্সে লোকটার দিন কেটে যাচ্ছিল বিশাল এক নিরাশার মধ্যে, অনিশ্চয়তার মধ্যে। আর ভবিষ্যতের সমস্ত অনিশ্চয়তা, আশাহীনতা, দেশের ভালোবাসার মানুষজনকে ভুলে থাকার জন্যে কখনো কখনো লোকটা একটু ড্রাগ, হেরোইনেরও আশ্রয় পেল – ঐ পরিস্থিতিতে যতটুকু পাওয়া যায় আর কি। তবে, কখনো ওকে নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্যে খরচ করতে হয় নি। পথের সঙ্গী সাথীরা যা জুটিয়ে দিত, তাতেই যা একটু আধটু নেশা করতো, লোকটা ঠিক নেশার দাস হয়ে উঠতে পারে নি – কোন এক আশা, অচেনা নিয়তি ওকে আনমনা করে দিত।

ভাবত, হয়তো কোন এক সকালে চোখ খুলে দেখতে পাবে ও তার দেশে নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝেই ওর দেশের কথা মনে হয়ে এক হৃদয় নিংড়ানো ব্যথা জাগত – বড় ইচ্ছে করতো ফিরে যেতে, দেশে গিয়ে গ্রামে বাড়ীর উঠোনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে – মা… মা…, বলে ডাকতে ইচ্ছে হোতো। সব কিছু তো ঠিকই ছিল, তবু কেন সে এখানে এসে পড়ল – ভাবলেই মাথাটা কেমন যেন ঘুরে যায়।

গরমের সময় তো কখনো পার্কের বেঞ্চে, কবর খানায়, কখনো রাস্তার পাশে রাত কাটানোর আস্থানা পেত, কিন্তু, শীত এলে বড়ই কষ্ট, তখন কখনো এ টি এম মেশিনের ছোট্ট ঘরে কয়েকজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে রাত কাটাতো। তাতেও আবার পুলিশের ভয় – যে কোন সময়ে এসে তাড়িয়ে দিতে পারে, ঠাণ্ডায় হয়তো সারারাত বাইরেই কাটাতে হতে পারে।

অবশ্য গ্রীস সরকার গৃহহীন, অনুপ্রবেশকারীদের অস্থায়ী ভাবে থাকার জন্যে বিশেষ জায়গা করে দিয়েছিল, সেখানে তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল। সেখানেও ছিল প্রচুর ভিড়, জায়গা নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, স্বজনপোষণ। লোকটা যেন কোন দলের সঙ্গেই খাপ খাচ্ছিল না, একাকী হয়েই থাকতো।

এথেন্সে দিনে দিনে ওর মতো প্রচুর লোক এসে যখন জুটল, আর, ওরা যখন গ্রীস সরকারের তরফ থেকে কোন আশ্রয় বা আশ্বাস পেল না – না পেল রাজনৈতিক আশ্রয় না আর্থিক সহায়তা না কোন কাজ, শুধু পেল নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ।

চলবে

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Uncategorized and tagged , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s