মানুষ ভালোবাসে গল্প শুনতে, শুধু শুনতে নয়, গল্প বলতেও ভালোবাসে। আর মানুষ সেই গল্প শুনেই শুধু থেমে থাকে না – এক কল্পনার জগত তৈরি করে সেই জগতে থাকতেও ভালোবাসে, বিশ্বাস করতে ভালোবাসে কিংবা বিশ্বাস করতে চায় – তাই বোধহয় মানুষকে নানা ধর্মের নানা ধর্ম গ্রন্থের গল্প শুনিয়ে ধর্ম বিশ্বাসী করে তোলা যায়, ধর্মের নামে ভাগাভাগি করে দেওয়া যায় – অন্য কোন প্রাণীকে গল্প শুনিয়ে কিছুতেই ভাগ করা যায় না, গল্প শুনিয়ে তাদের আবেগ বা চিন্তাকে নাড়া দেওয়া যায় না, কিন্তু মানুষকে গল্প শুনিয়েই সুখী, দুখী করে দেওয়া যায়, অনুভূতি জাগ্রত করে দেওয়া যায়, তাই, মানুষ গল্পে বিশ্বাস করে। আর মানুষের সেই আশ্চর্য বিশ্বাস করার ক্ষমতা, ফ্যান্টাসি তৈরি করার ক্ষমতা, গল্প বলার ক্ষমতা – সব দিয়েই মানুষ অন্যান্য প্রাণীকুলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে বিশাল এই সভ্যতা গড়ে তুলেছে।
লাইফ অফ পাই – চলচিত্রটিও যেন মানুষের সেই বিশ্বাস করার ক্ষমতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। এই চলচিত্রের গল্পের নায়ক তাই, ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে ওঠার জন্যে কখনো ক্রিশ্চান ধর্ম মতে ব্যপ্টাইজ হতে চাইছে, কখনো পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে ইসলাম ধর্মের মূল কথা জানতে চাইছে, আবার কখনো বিষ্ণুর কথাও জানতে চাইছে। এই চলচিত্র যেন ঠিক এক চলচিত্র নয় – এক গভীর আত্মবোধ। মানুষের বিশ্বাস করার ক্ষমতাকে যাচাই করার চলচিত্র।
কেন জানি না, শহরের ভিড়, যান বাহনের আওয়াজ, যান জট, জীবন ধারণের জন্যে দৈনন্দিন অস্থিরতা, গতি – সব কিছুকে একপাশে সরিয়ে যখন ‘লাইফ অফ পাই’ সিনেমাটি দেখেছিলাম – এক অদ্ভুত নির্জনতা, প্রশান্তি অনুভব করেছিলাম।
এক অন্য জগতের গল্প, সত্যি কারের এক ফ্যান্টাসি তৈরি হয়েছিল পর্দায়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, গল্পের নায়ক সত্যিই বাঘের সঙ্গে সহাবস্থান করে মাঝ সমুদ্রে দিন কাটিয়েছিল, সত্যিই মাঝ সমুদ্রে এক দ্বীপে গিয়ে নায়ক ও বাঘের নৌকো ঠেকেছিল – যে দ্বীপের গাছপালা সন্ধ্যা নামলেই মাংসাশী হয়ে যায়।
আবার শেষে, সন্দেহও জেগেছিল – সত্যিই কি সে বাঘের সঙ্গে এক নৌকোয় ছিল। নাকি পুরোটাই তার তৈরি গল্প, তার বেঁচে থাকার গল্প। কিংবা, এও হতে পারে, ভয়ংকরের মুখোমুখি থাকলে মানুষের বাঁচার ইচ্ছে আরও প্রবল হয়, বেঁচে থাকার লড়াইটাও তাই সে মনে প্রানে করে চলে – জীবন মানেও তো তাই – এক ধুরন্ধর শক্তিশালী রাগী বাঘকে ক্রমাগত পোষ মানিয়ে চলার চেষ্টা। আবার সেই ভয়ংকর বাঘের জন্যেই বেঁচে থাকা, বাঘকেই ভালোবাসা – যা কিনা নায়ক বুঝেছিল, সে বুঝেছিল, বাঘটি না থাকলে মাঝ সমুদ্রে হয়তো সে বেঁচে থাকতেই পারতো না, মাঝ সমুদ্রে বাঘটি ওকে বাঁচার আশা যুগিয়েছিল, বাঘ মানুষে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল।
গল্পের শেষে মনে হল, অনেকটা ঠিক, সেই সৃষ্টির প্রথম সময়ে যদি একটাই মানুষ থাকতো, আর সে যদি দু’টো গল্প বলতো – যে গল্পটা সবচেয়ে বেশী চাঞ্চল্যকর তাই হয়তো মানুষ বিশ্বাস করতো। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে – মাঝ সমুদ্রে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাক্ষী তো কেউ ছিল না, বাঘটি ছিল, কিন্তু, সে তো আর গল্প বলবে না। মানুষকেই বলতে হবে – আর বিশ্বাস অবিশ্বাস করার অধিকার না হয় ছেড়ে দেওয়া হোক মানুষেরই উপর।
সিনেমাটি আমি দেখেছি। অনেক ভালো লেগেছে। পুরো ছবি জুড়ে একটা উৎকণ্ঠা ছিল- কি হয়, কি হয়। যা দর্শকদের ধরে রেখেছে ঘটনার শেষ পর্যন্ত।
হ্যাঁ, উৎকণ্ঠা শেষ পর্যন্ত ছিল। বেশ ভালো লেগেছিল সিনেমাটি।
আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই, ভালো থাকবেন।