মা…মা…মা… আদিম চিরন্তন এক ডাক, অথচ কতো আধুনিক, কতো কাছের সেই ডাক।
ছোট্ট আমি ও মা – পৃথিবীর এক আদি সম্পর্ক – সেই সম্পর্কই ধরা দিয়েছিল কতো শিল্পীর তুলিতে, গল্পে, প্রেরনায়, ভাস্কর্যে। সেই সম্পর্কের ছায়াতেই শুরু হয়েছিল জীবনের পথ চলা।
মা শিখিয়ে দিয়েছিল কি ভাবে ‘ঋ’ লিখতে হয়, শিখতে হয়, জানতে হয়। তারপর, সময় চলেছে, চলতি জীবনের মুখোমুখি হতে হতে, হঠাৎ একদিন দেখি মায়ের বয়স অনেক বেড়ে গেছে – আমার সেই মায়ের চুলে দেখা দিয়েছে রুপোলী ঝিলিক, কোমরের ব্যথায় মা ঝুঁকে হাঁটতে শুরু করেছে, মা অনেক রোগা হয়ে গেছে।
মা কে আমি কোনদিনও ঐ রূপে কল্পনা করতে পারিনি, আমার সেই মা – ছেলেবেলায় দুপুরের ভাত ঘুমের ঘোরে চুড়ির রিনি রিনি শব্দে টের পেতাম মা স্কুল থেকে ফিরেছে।
মা তখন স্কুলে চাকরি করতো, ছোট্ট ভাই ও আমাকে পারিবারিক কাজের মানুষের কাছে লালল পালনের দায়িত্ব দিয়ে মা স্কুলের চাকরি সামলাতো। ভাইয়ের জন্মের আগে কখনো বা মায়ের সঙ্গে গাঁয়ের স্কুলে যেতাম, তখনও আমার পড়াশোনা শুরু হয় নি, বাঁশবন পেড়িয়ে ব্রিজের ওপারে ছিল মায়ের স্কুল – গ্রামের স্কুল।
ছোট্ট বেলা সবুজ জামা গায়ে, মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরার পথে কতবার আগে আগে নির্জন ব্রিজ পেড়িয়ে মা…আ…আ বলে ডেকেছি, আজও সেই ছবি চোখে ভাসে, হালকা ঝড়ের মুখে ব্রিজের এপার থেকে দেখছি মা আসছে, মাঝ পথে থেমে গিয়ে এক ডাহুক পাখি ওয়ালার পাখির খাঁচা দেখছে।
ছোট্ট আমি, দেখছিলাম মায়ের আঁচল চঞ্চল হাওয়ায় কেমন উড়ে চলেছে। আজও যখন জীবনের চলার পথে প্রচুর সমস্যার সমাধান খুঁজি, মনে হয় চিৎকার করে একবার মা…আ বলে ডাকলেই সব সমাধান হয়ে যাবে।
মা মানে কি? মা এক অনুভূতি, নিশ্চিন্ত এক অনুভূতি, এক সরল সহজ ব্যক্তিত্ব, আমার এক পরম মানসিক আশ্রয়। মা মানে – দুরন্ত জ্বরের সময় ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া, হলুদের গন্ধ ভরা আঁচল।
মা মানে – এক মিষ্টি গন্ধ, ভোরের পরশ। শরত কালে বাগানে প্রচুর শিউলি ফুটত, মা কুঁড়িয়ে নিয়ে এসে আমাদের ঘরে এনে রাখতো – সকাল হোতো শিউলির সুবাসে।
মা মানে – শিউলির সুবাস। আজও যেন বুক ভরে শিউলির সুবাস বুকে টানলে, মাকে কাছে পাই।
মা মানে – ব্লটিং পেপার।
দমবন্ধ করা এক কষ্ট যখন বুকের কাছে আটকে থাকে, যে কষ্ট চোখের জল হয়ে গলে যেতে পারে না, সেই কষ্টের কথা মাকে বলা মাত্রই দেখি, সে কষ্ট কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়।
মা যেন সমস্ত দুঃখ, কষ্টকে ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিতে পারে। নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। আমার জীবন বিস্তৃত সেই মাকে কি বছরের মাত্র একটা দিনে বেঁধে দিতে পারি? কিংবা এমনও হতে পারে – জীবন ধারণের অতি স্বাভাবিক জিনিস যখন আমরা ভুলে যাই – মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে একটা দিনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
আপনার লেখা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। 🙏
ধন্যবাদ।