পাহাড়ের আবহাওয়া ক্ষণিকের মধ্যেই বদলে যায়। আমাদের সুইস দিনের সকালটি শুরু হয়েছিল খুবই উজ্জ্বল ভাবে, কিন্তু আল্পসের অপূর্ব সুন্দর গ্রাম Grindelwald এ এসেই দেখি আকাশের মুখ প্রচণ্ড ভার – ধূসর। Grindelwald থেকেই জুংফ্র যাওয়ার ট্রেন ধরতে হয়, এখান থেকেই পাহাড়ের উপরের দিকে যাওয়ার জন্যে বিশেষ র্যাক রেলওয়ে ট্র্যাক শুরু হয়।
ইউরোপের সবচেয়ে উপরে অবস্থিত আল্পসের এই জুংফ্র চূড়া, বলা হয় – Top of Europe। সারাবছরই প্রচুর টুরিস্টদের স্বাগত জানায় এই আল্পাইন চূড়া। তবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আল্পসে যে কোন সময়ই তুষারপাত হয়, ঘন ঘন আবহাওয়া হঠাৎ হঠাৎ ই বদলে যেতে পারে, তাই ট্রেনে শুধু একদল জাপানি টুরিস্ট ছাড়া খুব একটা টুরিস্ট নজরে পড়ছে না। দু’ পাশের সুইস আল্পসের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, তুষার ঢাকা Eiger পাহাড়ের দৃশ্য সরে সরে যাচ্ছে। ভাবছি – উপরে পৌঁছে, ভাগ্য মন্দ থাকলে মেঘলা আকাশ বা বৃষ্টি, বেড়ানোর সমস্ত আনন্দ মাটি করে দিতে পারে। পাহাড়ে আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে চলতে হয়।
কিছুক্ষণ চলার পরেই, রীতিমত বুঝতে পারলাম, ট্রেনটি আল্পসের পাহাড়ি পথে উপরের দিকে চলছে, গতি ধীর হয়েছে, দম নিতে নিতে উপরের দিকে চলেছে। দু’পাশের সবুজ আল্পাইন জঙ্গল ছাড়িয়ে, উপরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ শুরু হল – তুষার পাত। তুলুসে তুষারপাত দেখেছিলাম, কিন্তু, এই প্রথম জঙ্গলের মধ্যে তুষারপাত দেখে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে যেন অবশ হয়ে গেলাম। জানালা থেকে চোখ সরাতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, চলুক এই অপূর্ব রেল যাত্রা। হালকা তুলোর মতো, ঝিরি ঝিরি তুষার পাতের মধ্যেই ট্রেন চলছে, যতই উপরের দিকে উঠছি তুষারপাতের পরিমাণ যেন বেড়েই চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক সাদা হয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্যে ভরে গেল চারিপাশ। অপূর্ব এই সৌন্দর্য দেখে ‘মেঘলা দিন’ নিয়ে মন খারাপের মেঘ দেখি একদমই উড়ে গেছে।
Kliene Scheidegg এ পৌঁছে জুংফ্র চূড়ার জন্যে আবার ট্রেন বদলাতে হবে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে cog-wheel রেলওয়ে। কিন্তু, Kliene Scheidegg এ পৌঁছে দেখি তুষার পাতের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে, সঙ্গে শুরু হয়েছে তুষার ঝড়। এমনি আবহাওয়ায় Kliene Scheidegg ছোট্ট ষ্টেশনের টি ভি পর্দায় ওয়েব ক্যামেরায় তোলা জুংফ্র চূড়ার আবহাওয়ার দৃশ্য ধারা বিবরণী চলছে। টি ভি পর্দাতেই দেখতে পাচ্ছি – জুংফ্র চূড়ায় ঘন অন্ধকার ছেয়ে আছে, সঙ্গে তীব্র তুষার পাত ও হাওয়া চলছে। এমনি আবহাওয়ায় ছোট্ট ভেজা ভেজা ষ্টেশনটিও রীতিমত ঝিমিয়ে আছে। পর্দায় বার বার ভেসে আসছে – ট্রেন আর উপরের দিকে যাবে না, হয়তো, বিকেলের দিকে আবহাওয়া ঠিক হলে যথারীতি ট্রেন চালু হবে।
ঠাণ্ডায় রীতিমত জমে যাওয়ার উপক্রম, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। ষ্টেশনের পাশে কয়েকটা ক্যাফেটেরিয়াতে পা রাখার জায়গা নেই – সবাই একটু উষ্ণতার খোঁজে ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুঁ দিচ্ছে। এমনি দিনে, ফেরার ট্রেনও অনেক দেরীতে। তাই, আমরাও এই আল্পাইন তুষার পাতের হিম শীতল দিনে উষ্ণতার খোঁজে এক খালি ক্যাফেটেরিয়া খুঁজে ঢুকে পড়লাম। সেদিনের, কাচের জানালার পাশে উষ্ণতার মধ্যে বসে, গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে, বাইরে সুইজারল্যান্ডের আল্পসের কোলে এই জায়গার এক অতীব শীতল দিনে, অঝোর ধারায় তুষার কণাদের ঝরে পড়া দেখার মধ্যে যে রোমাঞ্চকর অনুভূতির ছোঁয়া, তা যেন আজও অনুভব করি।