ওরা কারা ? (Felis catus….)

ইউরোপের নানা দেশে নানা পথে আমি দেখেছি অনেক মানুষের জীবন ছবি, অনেক ঐতিহাসিক শহরের বুকে শুনেছি আধুনিক জীবনের প্রতিধ্বনি, শুনেছি অনেক মাতাল করা সঙ্গীত সুর। কিন্তু, ইউরোপের জীবন যাপনের সঙ্গে আরেকটি প্রাণী – বেড়ালের উপস্থিতির কথা ভুলে গেলে কিন্তু একদম চলবে না।

যেখানেই গেছি নরম, তুলতুলে ছোট্ট প্রাণীটি ঠিকই নিজের দিকে আকর্ষণ করে নিয়েছে। শুধু কি জ্যান্ত বেড়াল! বেড়ালের কতো ধরণের মূর্তি যে হতে পারে, তা আগে জানতাম না – অবাক বেড়াল, হাসি খুশী, রাগি, গুঁফো, বদরাগী, মিচকে, বোকা সমস্ত ধরণের বেড়ালের মূর্তিই এখানে আছে।

ক্রোয়েশিয়ার দুব্রভনিক শহরটি একদম সমুদ্রের ধারে, আর সেখানে প্রচুর বেড়াল। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের পাশেই দেখি এক দু’জন ঘোরাফেরা করছে। ডাকলে কাছে এসে যায়, গায়ে হাত দিতে দেয়। এমনকি রাতে যে হোটেলে উঠেছি – সেখানেও বেড়ালই আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।

দুভ্রভনিক সিটি ওয়ালের খাড়া সিঁড়ির মুখেই দেখি একজন বসে আছেন, উপরে স্যুভেনিরের দোকানের বেচা কেনা লক্ষ্য করছেন – মন দিয়ে। আবার দুভ্রনভিকের সমুদ্র তীরে একদল বেড়াল জাহাজে করে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। স্যুভেনির শপের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম – এই জাহাজের ক্যাপ্টেন কে? হেসে মেয়েটি উত্তর দিল – এই জাতের প্রাণীরা কাউকেই ক্যাপ্টেন মনে করে না, সবাই এখানে ক্যাপ্টেন।

ক্রোয়েশিয়া দেশটির সর্বত্রই দেখি বেড়ালদেরই আধিপত্য। এমনকি, স্প্লিট শহরে রোমান স্কোয়ারের ভিড়ের মধ্যেই পাশের এক এন্টিক স্যুভেনির শপের মালিক বেড়ালের উপরে দোকানের সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব দিয়ে চলে যেতে দ্বিধা করে না! দেখি, সাদা বেড়ালটি দিব্যি দোকান সামলাচ্ছে – আশে পাশে হাজার টুরিস্টের আনাগোনা, ফটো তোলা ওর মনোযোগ এক্কেবারেই বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না।

শুধুই কি মানুষেরই কীর্তিই পৃথিবীতে উল্লেখ যোগ্য? বেড়ালেরও নানা কীর্তি আছে। পদার্থ বিজ্ঞানের এক গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়ে রীতিমত গবেষণার পেপার আছে এক বেড়ালের দখলে, তাও আবার Physical Review Letters এর মতো গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে। সম্মানীয় সেই বেড়াল মহাশয়ের নাম F.D.C. Willard

আবার অনেক কুখ্যাত বেড়াল, রাশিয়ার জেলে ড্রাগ সরবরাহ করে। অবশ্য, পুলিশ ঐসব কুখ্যাত বেড়ালদের ধরতে পারলে গরম দুধ খেতে দেয়। অনেক জায়গায় তো আবার গোয়েন্দা বেড়ালরা স্পাইয়েরও কাজ করে।

কোন এক বেড়াল যে কিভাবে এক হতাশা গ্রস্ত মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তন করে, এক নতুন জীবন দিতে পারে, তা বব নামে বেড়াল সারা পৃথিবীকে জানিয়েছে ও দেখিয়েছে।

ফ্রান্সে এসে কতো বেড়ালের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে, কি বলি। যাওয়া আসার পথে প্রায়ই এক সাদা বেড়ালের সঙ্গে দেখা হয় – প্রতিদিনই বিকেলের দিকে গা এলিয়ে বসে থাকে, আর মানুষের আনাগোনা দেখে। গায়ে হাত দিলে কোন আপত্তিই করে না। প্রতিদিন বিকেলেই ওর নাকি একবার পাড়া ঘুরে আসা চাইই চাই। একবার অনেক রাতে বাড়ী ফিরছিলাম, বাস স্ট্যান্ডে কেউই ছিল না, ঠাণ্ডায় একা একা বসে বেশ বিরক্তি লাগছিল – হঠাৎ দেখি আমার পাশে গুটি গুটি ভাবে এসে বসেছে ধবধবে সাদা ফুরফুরে লোমশ এক বেড়াল। কাছে ডাকতেই চলে এলো আরও পাশে, একদম গা ঘেঁসে বসল- এখানের বেড়ালদের খুবই বন্ধুত্ব পূর্ণ ব্যবহার। সেই রাতে বাসের জন্যে দীর্ঘ অপেক্ষার বিরক্তি একদম চলে গিয়েছিল ঐ সাদা বন্ধু বেড়ালের উপস্থিতিতে।

তুলুসের কম্পান্স ক্যাফেরলি পার্কে সাদা কালো এক বেড়াল প্রায় দিনই এসে রোদ পোহায়। বেশ মোটা বেড়ালটি প্রতিদিনই ঝোপের ধারে বসে থাকে, পার্কে বেড়াতে আসা লোকেরা ওকে কোলে নেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় – বিন্দু মাত্র আপত্তি করে না, বরং আমেজে ওর চোখ বুজে আসে। কম্পান্স ক্যাফেরলি পার্কে আমি গেলেই ও পাশে এসে বসে – ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওর সঙ্গে।

ডিসেম্বরের শীতের এক রাতে ঘরে ফেরার পথে এক বন্ধু বেড়াল আমাদের পিছু নিয়েছিল। আমাদের বাড়ীর ঠিক উল্টো দিকে এক ব্যঙ্কের পাশে ঘাপটি মেরে সে বসেছিল সেই রাতে। শুনশান পথে শুধু আমরাই ছিলাম – হঠাৎ দেখি বেশ হুমদো এক ধূসর বেড়াল পায়ে পায়ে গা ঘষছে। অগত্যা কোলে নিয়ে বাড়ীর বাইরে কিছুক্ষণ পায়চারী করলাম – হয়তো আশেপাশের কারোর বেড়াল হবে। রাত এগারোটা বাজছে – শীতের এতো রাতে তো বাইরে থাকার কথা নয় ওর।

তবে তুলুসে নৈশ ভ্রমণরত বেড়াল প্রায়ই নজরে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে বেড়াল বাবাজীকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। চলে যাক নিজের বাড়ীতে, নয়তো কাল সকালেই হয়তো দেখবো বাস স্ট্যান্ডে ওর পাসপোর্ট সাইজ ফটো ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ ‘পারদু’ মানে ‘হারানো’ লেখা পোস্টার, ছবির নীচে আবার মালিকের ইমেল অ্যাড্রেস, ফোন নম্বর, কি নামে বেড়াল সাড়া দেয় সবই লেখা থাকে। আগেও অনেক বেড়াল হারানোর পোস্টার দেখেছি। কেউ কেউ তো আবার সমস্ত ল্যাম্প পোষ্টে নিজের বেড়াল হারানোর পোস্টার দেয়। তবে, এই বন্ধু বেড়ালটি  দেখি কোথাও যাচ্ছে না, সেদিন অনেক রাত পর্যন্তই সে বাইরে ছিল।

একবার তো প্রায় পনেরো দিন আমাদের তুলুসের বাড়ীতে, দেভিক ও গেঞ্জি নামে দুই বেড়াল অতিথি হয়ে এসেছিল। প্রথম যেদিন দেভিক আমাদের বাড়ীতে এলো সেদিন আমি ইলিশ মাছ ভাজছিলাম। কি আশ্চর্য, ফ্রান্সের বেড়াল ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে বিন্দু মাত্র বিচলিত হল না। বরং ঘরে ঢুকেই ঘরের সমস্ত কোণা শুঁকে শুঁকে দেখতে শুরু করেছিল। শেষে এক কোণা বেছে নিয়ে আমাদের দিকে পেছন করে বসে দেওয়ালে মুখ গুজে কাটিয়ে দিয়েছিল প্রায় সাত দিন। ছোট্ট গেঞ্জির কিন্তু কোনও অসুবিধা হয় নি, ঘরে ঢুকেই সামনে যা পাচ্ছিল তাই একবার করে কামড় দিয়ে দেখে নিচ্ছিল তার স্বাদ। ধীরে ধীরে যখন মানিয়ে নিয়েছিল আমাদের বাড়ীর সঙ্গে- ব্যাস ওদের চলে যাওয়ার দিন চলে এসেছিল। ওদের চলে যাওয়ার দিনে আমাদের বেশ মন খারাপই লাগছিল, বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। প্রান যতই ছোট হোক না কেন, তাঁদের উপস্থিতির এক উত্তাপ আছে।

তুলুস ইউনিভার্সিটি চত্বরে অন্তত পঞ্চাশ ষাটটা বেড়াল ঘোরাফেরা করে। নানান ধরণের অতি সুন্দর সুন্দর মোটাসোটা বেড়ালদের দেখে প্রায়ই ভাবতাম ওরা খায় কি, তীব্র ঠাণ্ডায়, তুষার পাতের সময় থাকে কোথায়। একদিন সমস্ত কৌতূহল নিবারণ হয়ে গেল – দেখি দলে দলে বেড়াল ইউনিভার্সিটি বিল্ডিঙের নীচ থেকে বেরোচ্ছে। আসলে এখানে বিল্ডিঙের নীচে বেসমেন্ট থাকে, আর কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকে যায়, শীতে ওদের আরামদায়ক আশ্রয় সেই বেসমেন্ট।

পরে আরও জেনেছিলাম এই ইউনিভার্সিটির সেক্রেটারি প্রতিদিন বিকেলে বেড়ালদের খাবার দিয়ে যান। শীত, বৃষ্টি – কখনোই ভদ্রমহিলা বাদ দেন না। একদিন সেই ভদ্রমহিলা যখন খাবার দিচ্ছিলেন, আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখি, সব বেড়ালরা নানান সুরে মিউ করতে করতে ওনাকে ঘিরে ধরেছে। ঝুড়ি ভর্তি করে খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি – টিনড সারদিন, স্যলমন, টুনা মাছ, স্বাস্থ্যকর সব খাবার। এমনি যাদের পথ্য তাঁদের ভালো স্বাস্থ্য হবে না তো কার হবে! শীত বা গরমের ছুটিতে ইউনিভার্সিটি চত্বর যখন ফাঁকা হয়ে যায়, ইউনিভার্সিটি চত্বর সম্পূর্ণ বেড়ালদের দখলে চলে যায় – ওদের মুক্তাঞ্চল হয়ে দাঁড়ায়! খোলা করিডোরে দলে দলে রীতিমত বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, রোদ পোহায়, গা চাটে।

যাইহোক, তুলুসে এক ভদ্র মহিলার বাড়ীতে এক মোটা, লোমশ বেড়ালের সঙ্গে পরিচয় হল। ভদ্রমহিলার মেয়ে বাইরে থাকে, তিনি জানালেন – জানো তো, আমার মেয়ে বাড়ী আসার এক দু’ দিন আগে থেকেই ও মেয়ের চেয়ারে গিয়ে বসতে শুরু করে। কি ভাবে জানতে পারে যে আমার মেয়ে আসছে? বিশ্বাস করতে পারো? হুম, বিশ্বাস করি বই কি। ইঁদুরের মতো দ্রুত গামী প্রাণীকে যে এক থাবায় শিকার করতে পারে সে সবই পারে।

ওদের কৃতিত্বের ব্যাপারে কারোর কোন সন্দেহ হলে একবার 100 Cats Who Changed Civilization বইয়ের পাতা গুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া উচিত।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Croatia, Europe, France, Inspirational, Memory-Lane, Travel and tagged , , , , , , . Bookmark the permalink.

2 Responses to ওরা কারা ? (Felis catus….)

  1. Atanu Das বলেছেন:

    খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা। মনশ্চক্ষে ভেসে উঠলো আমাদের গ্রাম-বাংলার দুঃস্থ, রুগ্ন, হাড়-জিরজিরে বেড়াল গুলোর চেহারা। পুরো অপোজিট পিকচার। সারাদিন দুমুঠো (দুথাবা হওয়া উচিত) খাবার জোগাড় করার চিন্তাতেই শেষ। কষ্টের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আর তাতে মানুষের অবদান দেখে তাদের আর মনুষ্য জাতির সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনের বিশেষ উৎসাহ-ও লক্ষ্য করা যায় না। তবে এরাও কিন্তু বিন্দাস আছে।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s