বিশাল পৃথিবী, কোটি কোটি মানুষ। বিশ্ব জুড়ে নানান রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। মানুষের হিংসা, কূটনীতির বলী মানুষ। পৃথিবী থেকে যেন মানুষের বিশ্বাস উবে যাচ্ছে, মানুষ যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে, মানুষ আরও বেশি একাকী হয়ে চলেছে।
এমনি এক সময়ে ববের জন্ম লন্ডনের কোন এক রাস্তার মোড়ে, কোথায় সে ববের জানা নেই, বব নিতান্তই অবলা প্রাণী। বসন্তকালে লন্ডনের শীতে জর্জর বব, দুর্বল বব, আহত বব আশ্রয় খুঁজছে। এই বিশাল পৃথিবীর ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে, মানুষের নির্মমতার ভিড়ে ববের মতো কত প্রাণীই তো প্রান হারায়, কেই বা তাঁর খোঁজ রাখে, কেউই তার দিকে ফিরে তাকায় না কিন্তু এই গল্পের নায়ক বব আশ্রয় পেল এক নেশাখোর ভ্যাগাবন্ড ভিখারি যুবকের ঘরে।
ভিতু, দুর্বল আহত অসহায় ববকে নিয়ে যুবকটি গেল পশুদের হাসপাতালে, চিকিৎসা করল, সুস্থ হওয়া পর্যন্ত নিজের কাছে রাখল, আর ভাবল হয়তো আশেপাশের বাড়ীর কারোর হারান বেড়াল ছানা হবে কিন্তু কেউই বেড়ালের খোঁজে এল না এমনকি যুবকটি বেড়ালটা নিয়ে লোকের বাড়ীতে গিয়েও জিজ্ঞাসা করল কিন্তু কেউই বেড়ালের দাবি জানাল না।
যুবকটি গৃহহীন, ড্রাগে আসক্ত, ড্রাগ আসক্তদের সরকারের তরফ থেকে চিকিৎসার জন্যে সরকারের দেওয়া ঘরে থাকে আর লন্ডনের রাস্তায় গিটার বাজিয়ে গান করে উপার্জন করে। নৈরাশ্যের শেষ সীমা দেখে নিয়েছে যুবকটি, নিরাশা যুবকের জীবনের সঙ্গী। জীবন থেকে নতুন করে আর কিছু পাওয়ার নেই। বেড়াল নিয়ে সে কি করবে যার নিজেরই ঠিকানা নেই।
যুবকটি বেড়ালটাকে রাস্তায় ছেড়ে দিল, ভাবল আর কখনও দেখতে পাবে না, ভাবল হয়তো বেড়ালটা নিজের রাস্তা খুঁজে নেবে ফিরে যাবে তাঁর প্রকৃত মালিকের কাছে কিন্তু এই কয়েক দিনে বেড়ালটার স্মৃতি ভ্রংশ হয়ে গেছে ও আর অন্য কাউকে চেনে না যুবকটি ছাড়া। যুবকটি দেখল বেড়ালটা ওর পিছু নিয়েছে এমনকি বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পিছু নিয়েছে।
নেশাগ্রস্ত কিন্তু মায়া মমতা ভরা মানুষটি যুবকের ভেতর থেকে জেগে উঠল, ভাবল বেড়ালটা ওকে এতো ভালবেসেছে, সে এবার বেড়াল নিয়েই বাস্কিং এ যাবে লন্ডনের রাস্তায়। যুবকটি বেড়ালের নামকরণ করল এক আমেরিকান টেলিভিশন সিরিয়ালে এক চরিত্রর নাম অনুসারে। নিজের যার নুন আনতে পান্তা ফুরায় সে আশ্রয় দিল বেড়ালটাকে।
সে’দিন হয়তো নিয়তি দেবী মুচকি হেসেছিলেন। এক বিশাল পরিবর্তন অপেক্ষা করেছিল দু’জনের জীবনে।
তারপর থেকে যুবকটির প্রতিদিনের বাস্কিং এর সঙ্গী বব। যুবকটির সঙ্গে বসে থাকে ব্যস্ত লন্ডনের রাস্তার ধারে। কোনোদিন Covent Garden কোনোদিন Piccadilly তে যুবকটি যখন গিটার বাজায়, গান গায় গম্ভীর হয়ে বসে শোনে।
গলায় রঙিন উলের সুন্দর মাফলার পরা বব প্রচুর লন্ডন বাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যুবকটি ববকে হাই ফাইভ করতে শেখায়। দেখতে দেখতে ববের কথা ছড়িয়ে পড়ে, ধীরে ধীরে ববকে দেখতে রাস্তায় ভিড় জমে, প্রচুর ফটো ওঠে, ভিডিও হয়, youtube এ আপলোড হয় ববের ভিডিও, জনপ্রিয়তা বাড়ে ববের।
যুবকটিও যেন নতুন ভালবাসার সন্ধান পায়, জীবনের বেঁচে থাকার উদ্দ্যেশ্য পরিষ্কার হয়, দায়িত্ব বোধ জন্মায়। নেশা ছেড়ে দেয়, যুবকটিও সুস্থ হয়ে ওঠে। এবার প্রতিদিন সকালে উঠে মনে হয় বাঁচতে হবে ববের জন্য, ভাল থাকতে হবে ববের জন্য, পৃথিবীতে বব ছাড়া আর কেউ নেই ওর, ওর প্রতিদিনের বাঁচা সার্থক এই অবলা জীব ববের জন্য। বব যুবকটির জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়ে এক নতুন জীবন দিল।
সম্পূর্ণ নৈরাশ্য, হতাশায় ডুবে যাওয়া যুবকটিকে বব ফিরিয়ে দিল সুন্দর নতুন নেশামুক্ত জীবন। বব যেন দেখিয়ে দিল জীবনের উদ্দ্যেশ্য, ভালবাসার মহিমা, এক অসম ভালবাসার জোর।
নিজের এই পরিবর্তনে যুবকটি নিজেও আশ্চর্য হয় ভাবে নিজের আর ববের দেখা হওয়া থেকে নিয়ে এই আশাবাদী যাত্রার কথা লিখবে। যুবকটি লেখে তাঁর জীবনে ববের ভুমিকা নিয়ে, তাঁর প্রথম বই “ A Street Cat Named Bob”। যুবকটির নাম James Bowen।
2010 এ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর আলোড়ন ওঠে, Sunday Times এর বেস্ট সেলার তালিকায় একান্ন সপ্তাহের বেশি প্রথম স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল। ছয় লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে আর ছাব্বিশটা ভাষায় অনূদিত হয়ে গেছে। খুব শিগ্রি সিনেমাতেও রূপান্তরিত হবে। বাচ্চাদের গরমের ছুটিতে বই পড়ার লিস্টে এই বই জায়গা পেয়েছে।
বব এখন সেলিব্রিটি, নানান টেলিভিশন শো তে দেখা যায়। সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস ববের গাম্ভীর্য এবং সরলতাকে একটুও আঁচড় কাটতে পারে নি। বব এখনও লন্ডনের রাস্তায় Bowen এর সঙ্গে বাস্কিং এ যায়, থাবা গুটিয়ে বসে, গান শোনে, হাই ফাইভ করে আর অনেক অনেক ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়, কোন বিরক্তি নেই, অহঙ্কার নেই। এতো বড় সাফল্য ববের চরিত্রের কোন তারতম্য ঘটায় নি। জীবন যাত্রার কোন বদল ঘটায় নি। এখনও সে Bowen এর ঘাড়ে চেপে সারা লন্ডন ঘুরে বেড়ায়। একেই বলে ‘বিড়াল তপস্বী’ সুখে দুখে নির্বিকার।
এ গল্প রূপকথার গল্প বলে মনে হয় না কি? এ গল্প শুধু যে বব আর Bowen এর গল্প তা নয়। এ গল্প নিরাশা থেকে আশার দিকে যাওয়ার গল্প, বিশ্বাসের গল্প, নির্ভরতার গল্প, দায়িত্ববোধের গল্প। শুরু অতীব সাধারণ ভাবে, জীবনের নিরাশার হাত ধরে, আর শেষ অসাধারণ ভাবে, এ গল্প জেতার গল্প, জীবনের গল্প।
Ei section ta porlam, khub bhalo laglo…. aro likhis…..
অসাধারণ ঘটনা, অসাধারণ সহজ ভাষায় লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সব লেখা একটু একটু করে পড়ছি। ভ্রমণের ছবি সহ লেখাগুলি এত ভালো আমার পরিব্রাজক মন তৃপ্ত হচ্ছে আপনার লেখা পড়ে। থামবেন না। লিখে যাবেন আরোও আরোও, অন্তত আমাদের জন্য, যারা সাধ থাকলেও নিজের গন্ডির বাইরে যেতে পারলাম না কোনোও দিন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। পরিব্রাজক মনই আসল, সবাই আমরা সীমার মাঝেই অসীমকে খুঁজি, তাতেই আনন্দ। আপনাদের আশীর্বাদে লিখে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আপনার লেখাও পড়ছি, খুব ভালো লেগেছে। ভালো থাকবেন ও আপনি আরও লিখে যাবেন।
ধন্যবাদ। 🙂