রেললাইন থেকে হিমালয় ( Rail track to Mount Everest journey)

একটি মেয়ে আবার জেনারেল নলেজের বই এ জায়গা নিল। মাউন্ট এভারেস্টের  চূড়ায় প্রথম ভারতীয় মহিলা বিকলাঙ্গ অরুণিমা সিনহা। ‘বিকলাঙ্গ’ শব্দটা নিজেই যেন বিকলাঙ্গ, এই শব্দটাই মানুষের মনোবল অনেক দুর্বল করে দেয়। সেই মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা প্রথম বাধা, তারপর আছে মানুষের সহানুভূতি যা আরও ক্ষতিকারক। তাঁর চেয়ে ইংলিশ কথা “amputee’’ অনেক বেশি বাস্তব, অন্তত মানসিক দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে না।

চলন্ত ট্রেন থেকে এক মেয়েকে ঠেলে ফেলে দিল কয়েকজন যুবক। এ কেমন বর্বরতা, এ কোন সভ্যতা। কিন্তু অরুণিমা দেখিয়ে দিল বর্বরতার জবাব বর্বরতা নয়। জীবন হিমালয়ের মত উঁচু, হিমালয়ের মতই প্রসারিত, হিমালয়ের মতোই দৃঢ়।

মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটি কতো কষ্ট করে রাজ্যের ভলিবল দলে খেলেছিল। কিছু বর্বর, অসভ্য লোক শুধু কিছু টাকা ছিনতাই করতে গিয়ে মেয়েটিকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে ফেলে দিল। তাঁদের কি শাস্তি হয়েছিল? কেউ জানে না। হয়তো ওরা এখনও সেই ট্রেনেই ছিনতাই করছে। পুলিস তাঁদের টিকির নাগাল পায় নি, বা পেলেও কিছু ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে।

প্রশাসন চুপ। এমনকি ভারতীয় ভলিবল ফেডারেশন মেয়েটির চিকিৎসার খরচ দিতে অস্বীকার করে দেয় প্রথমে। শোনা যায়, যে লোকটি আহত মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছেছিল পুলিশ তাঁকে ছেড়ে কথা বলে নি। অনেক হেনস্তা করেছে। কিন্তু এখনও কিছু মানবতা বেঁচে আছে, তাই মেয়েটিকে কেউ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল।

সমস্ত দুর্বলতার জবাব হিমালয়। AIIMS এর হাস্পাতালের বিছানায় শুয়ে যেদিন শুনেছিল ওর বাঁ পা হাটুঁর নীচ থেকে বাদ দিতে হবে, আর এক পায়ে রড থাকবে, সেদিনই তো মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার কথা, সেদিনই মেয়েটির হেরে যাওয়ার কথা। পৃথিবীর যাবতীয় সহানুভূতি পুঞ্জি করে বাকি জীবনটুকু কাটানোর কথা। কিন্তু না, মেয়েটির মনের গড়ন এতো কাঁচা নয়। মেয়েটি তাকিয়েছিল হিমালয়ের দিকে। সমাজের করুণা নিয়ে বাঁচতে চায় নি মেয়েটি। মেয়েটি ভেবেছিল যদি শয্যাশায়ী হয়েও কাটাতে হয় জীবন, তবুও হিমালয়ের চূড়ায় পৌঁছবে।

মেয়েটি এমন এক খেলা বেছে নিল, যে খেলায় সে নিজে খেলোয়াড়, নিজেই চিয়ার লিডার, নিজেই দর্শক। যে খেলায় ভুলের কোন জায়গা নেই, এক পা ভুল ফেলা মানে মৃত্যু। এ খেলা অসম্ভব কঠিন। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, অসম্ভব ঠাণ্ডা, তুষার ঝড়, বিশালতার মাঝে একাকী এই খেলা, কতো জন প্রান হারায় এই খেলায়।

অন্য খেলার মতো কেউ এই খেলায় চিৎকার করে মনোবল বাড়ায় না, চার ছয়ে সুন্দরী মেয়েরা নাচে না, কোটি টাকার বেটিং হয় না এই খেলায়। এ খেলা বিপজ্জনক, এ খেলা মরণ খেলা – ‘আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা’।

তারপর তো মেয়েটির ধ্যান, সাধনা, অধ্যবসায়, চেষ্টা, পরিশ্রম এর কথা সাধারণ মানুষ জানে না। মানুষ শুধু এরেনার খেলা দেখে, সাফল্য দেখে। টিভিতে দেখা যায় খেলার খবরের সঙ্গে।

কিন্তু, ভাবা যতই সহজ ছিল, পথ ততই কঠিন ছিল। এক পায়ে পাহাড় ডিঙ্গনোর কথা গল্পে পাওয়া যায়। বাস্তবে কঠিন তাও আবার মেয়ে, ‘অবলা প্রাণী’। কিন্তু বাচেন্দ্রি পাল মেয়েটিকে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি মেয়েটিকে ট্রেনিং দিতে শুরু করেছিলেন।  আর বিশ্বাস করেছিল Tata Steel Adventure Foundation, উত্তরকাশি। মেয়েটি সেখানে যোগ দিয়েছিল।

সে ছিল এক গভীর তপস্যা। সমস্ত শারীরিক মানসিক কষ্টের উপরে উঠে যাওয়ার এক কঠিন অধ্যবসায় ছিল মেয়েটির প্রতিদিনের বাঁচায়, প্রতিদিনের মননে, প্রতিদিনের চিন্তনে। তিলে তিলে প্রতিদিন লড়াই করে মেয়েটি নিজেকে তৈরি করেছে।

পাহাড় ছবিতে যতই সুন্দর বাস্তবে ততই ভয়ঙ্কর। পাহাড়ি পিছল পাকদণ্ডীর প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে বিপদ। তাছাড়া পাহাড়ের আবহাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা নেই, এই ঝড় বৃষ্টি তো এই রোদ্দুর। এই কঠিন পথে চলার জন্যে শরীর এবং মন লৌহ কঠিন করতে হয়।

মেয়েটির ছয় জনের দলটি হিমালয়ের চূড়ার দিকে চড়ার সময়ে অসফল অভিযাত্রীর মৃত দেহ দেখে। ওদের চোখের সামনেই বাংলাদেশের এক অভিযাত্রী প্রান হারায় অক্সিজেনের অভাবে। সহযাত্রীর মৃত্যু দেখেও লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয় অভিযাত্রীকে, মন শক্ত করতে হয়।

মেয়েটির ও অক্সিজেন কমে গিয়েছিল অনেকে বলেছিল থেমে যেতে, কিন্তু মেয়েটি নিজের লক্ষ্যে ছিল দৃঢ়। শেষ পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে গিয়েছিল। পাহাড়ে চড়া যেমন শক্ত তার চেয়ে বেশি কঠিন নামা, এক পা ভুল ফেলা মানে হিমালয়ের বুকে চিরনিদ্রা।

মেয়েটি পেরেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছে। সমস্ত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ছুঁয়েছে নিজের স্বপ্ন। রেললাইনের ধারে এক দুর্ঘটনা মেয়েটির ভাগ্য বদলে দিল? নাকি মেয়েটি নিজের ভাগ্যের দায়ভার নিজের হাতে তুলে নিল?

মেয়েটি ভবিষ্যতে উত্তর প্রদেশের উন্নাও শহরে গরীব এবং শারীরিক ভাবে অসক্ষম বাচ্চাদের জন্য এক sports academy খুলবে। জানি ও পারবে, আরও অনেক মানুষকে পথ দেখাবে, সাহস দেবে। ভারতবর্ষে এই অন্ধকার সময়ে অরুণিমার মতো কোটি কোটি মেয়ের জন্ম হোক, আশার আলো দেখাক, আলোর দিকে নিয়ে চলুক।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Inspirational and tagged , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s