April 2010, Pompei, Italy
ট্রেনটা যে অনেক্ষণ ধরে ভুল পথে চলছে আমাদের দু’জনের কেউই বুঝতে পারছিলাম না। বেড়ানোর আনন্দে দু’জনের কোন হুঁশ নেই। দু’জনেই ইতালির সুন্দর চলমান গ্রামীণ জীবন যাত্রা দেখতে দেখতে মশগুল হয়ে চলেছি।
গরমের সময়ে ইতালিতে খুব গরম পড়ে। খুব গরম আর রোদ এখন। ইতালির এই দিকটা বেশ রুক্ষ এবং সুন্দর। যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত ঢালু উঁচু নিচু জমি। দূরে রুক্ষ পাহাড়শ্রেণী। দূর দিগন্ত হাল্কা কুয়াশায় আবছা।
ট্রেনের জানালা দিয়ে ইতালির গ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রার ছবি দু’ধারে সরে সরে যাচ্ছে ।
এপ্রিলের রুক্ষ দমকা বাতাসে ভাসছে লেবুফুলের গন্ধ, এখানের ট্রেনটা আমাদের দেশের ট্রেনের মতই। ট্রেনে লোকজন খুবই কম, স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন থামছে, গ্রামীন লোকজন ওঠা নামা করছে অথচ কাউকে দেখেই মনে হছে না যে টুরিস্ট।
ট্রেন চলছে আমরাও চলছি কিন্তু ভিসুবিয়াস বা পম্পেই এর কোনো নিশানা নেই।
অথচ আমরা ইন্টারনেট ঘেটে জেনে এসেছি যে নেপলস থেকে সার্কাম্ভিসুবিয়ানা (Naples-Sorrento) ট্রেন লাইনের দশ বারোটা স্টেশন পরেই আমরা ভিসুবিয়াস দেখতে পাব, ভিসুবিয়াস আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলবে কিছুদূর। অথচ ভিসুবিয়াসের কোনো লক্ষণ নেই আর পম্পেই এর আগের স্টেসন আমরা জেনে এসেছিলাম ‘পম্পেই’ তারপরের ষ্টেশন pompei scavi villa dei misteri তে আমাদের নামতে হবে, এই ষ্টেশন থেকে নেমেই উল্টোদিকে পম্পেই শহরের ধ্বংসাবশেষ মাত্র একশ মিটার।
ট্রেনের সময় অনুযায়ী আমাদের এখন পম্পেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। এবার ট্রেন খালি হতে চলেছে। কোন টুরিস্ট স্পটে যাওয়ার ট্রেনে অন্তত কেউ তো টুরিস্ট থাকবে। সবাইকে দেখে তো এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছে।
ট্রেন থেমে গেল, সবাই নেমে গেল। এ’টাই শেষ ষ্টেশন, খালি ট্রেনে আমরা দু’জন বসে রয়েছি, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কোথায় এলাম? বেশ আশঙ্কা হচ্ছে দু’জনের।
এক জন গার্ড গোছের লোক দেখে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সে জানাল- তোমরা সম্পূর্ণ ভুল দিকের ট্রেনে চেপেছ, তোমরা Sorrento র ট্রেনে না চেপে Sarno র ট্রেনে চেপেছো। এই ষ্টেশনের নাম Poggiomarino । তোমরা সামনের প্লাটফর্মে ঐ দাঁড়ানো ট্রেনে চেপে Torre Annunziata চলে যাও। ওখানে আবার পম্পেই যাওয়ার ট্রেন পেয়ে যাবে।
সেদিন আমাদের বেশ সময় নষ্ট হয়েছিল শুধু ট্রেনে। আসলে যখন কোথাও বেড়াতে যাই টুরিস্ট গন্ত্যব্য গুলোই এতো মুখ্য হয়ে ওঠে যে পথের এই সময় নষ্টটুকু অহেতুক বলে মনে হয়। বেড়াতে গেলে এই ধরণের অভিজ্ঞতা বেড়ানো কে আরও স্মরণীয় করে তোলে।
পম্পেই শহর পৌঁছলাম প্রায় দু’টো নাগাদ, সেই দুপুর একটায় নেপলসে ট্রেনে চড়েছিলাম।তীব্র গরম, দূরে ভিসুভিয়াস দেখা যাচ্ছে। প্রচুর টুরিস্টের ঢল নেমেছে।
পম্পেই এর প্রত্নত্বাতিক এলাকা প্রায় 66ha, তাঁর মধ্যে প্রায় 45ha খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। ভিসুবিয়াসের লাভা দিয়ে গঠিত মালভূমির উপরে পম্পেই শহর গড়ে উঠেছিল, কিছু দূরেই আছে Sarno নদী উপত্যকা। শহরের সঠিক উৎপত্তি কখন জানা নেই, অনুমান করা যায় 7BC তে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পম্পেই শহরের নানান জায়গায় খনন কাজ হয়েছে। শহরে ঢোকার বড় গেট আছে। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম, প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাগবে পুরো শহর আবিষ্কার করতে।
এই ঐতিহাসিক শহরের অসাধারণ architecture, sculptures, painting, mosaics ইত্যাদি গবেষকদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
শহর জুড়ে নানান ঐতিহাসিক মনুমেন্টের ধ্বংসাবশেষ। খুব সযত্নে এতো পুরনো সভ্যতার নিদর্শনকে ধরে রেখেছে ইতালির সরকার।
পশ্চিম দিকে ভেনাস দেবীর মন্দিরের বড় বড় থাম এখন মাথা উঁচু করে সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তখনকার দিনের amphitheaters, অ্যাপেলো মন্দির, ব্যাবসায়ির বাড়ী, প্রধান বাজার এলাকার বিল্ডিং, রাজার দরবার, সরকারি দপ্তর, সাধারণ মানুষের বাড়ী, স্নান ঘর এবং বাগান ইত্যাদি সব কিছুর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে এখানে।
পম্পেই এক শশ্মানপুরী, রোমান রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ। ভিসুভিয়াসের পাদদেশে এই শহরে রুক্ষ পাথুরে রাস্তা, গাছ পালা নেই শহরের ভেতর। অথচ ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের আগে নাকি এখানের জমি অনেক উর্বর ছিল চাষ হত, পম্পেই এর লোক খুশি ছিল, ব্যবসা বানিজ্য হত। দ্রুত এই শহরের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছিল।
ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা ও ছাই ছড়িয়ে পড়ে (79AD) পম্পেই আর হেরকুলেয়াম শহরের উপরে আর এই দুই শহরের বাসিন্দারা তৎক্ষণাৎ প্রান হারায়, এক জীবন্ত চলমান শহরের জীবন নিমেষে থমকে যায়। আগ্নেয়গিরি ও তার লাভার তাপমান নাকি প্রায় 240°C ছিল, এই তাপমাত্রায় কোন প্রাণী জীবিত থাকতে পারে না।
সেদিনের প্রকৃতির ধ্বংসলীলার প্রমান এখানের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, এক জায়গায় মানুষের পাথর হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ রাখা আছে, পাশে তাঁর প্রভুভক্ত কুকুরও পাথর হয়ে গেছে। সবাই দীর্ঘদিন লাভা আর ছাই চাপা পড়ে ছিল, খনন করে এই শহরকে আবার উদ্ধার করা হয়, আর প্রায় 250 বছর ধরে এখানে টুরিস্ট আসে, ইতালির দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে এ অন্যতম আর UNESCO র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
এই শহরের গলি ঘুঁজি ধরে চলতে চলতে সাধারণ লোকের বাড়ী ঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়, মনে হয় এখনও হয়তো রাত যখন গভীর হয় সেই দিনের মৃত শহরবাসীর অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়, হয়তো গভীর রাতে অশরীরী জেগে ওঠে আবার এই শহরকে জমজমাট করে তোলে, সেদিনের মতো হয়তো বা রোমানদের ব্যাবসা বানিজ্য চলে।
পম্পেই এ এসে প্রকৃতির কাছে নিজেদের শক্তির ক্ষুদ্রতাকে, নিজেদের অসহায়তাকে, অক্ষমতাকে যেন যাচাই করে নিলাম। প্রকৃতির রোষের কাছে মানুষ কতো নগণ্য তাঁর নমুনা দেখে নিলাম। মানুষের স্পর্ধাকে এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে প্রকৃতি।