পর্তুগালের কাছে যখন বিংশ শতাব্দীর শেষ World Exposition ‘98 এর সুযোগ এলো, কোথায় হবে সেই বিশ্ব প্রদর্শনী, সেই নিয়ে লিসবনে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। তার আগে ইউরোপের অনেক দেশ অনেক রকমের আশ্চর্য স্থাপত্য তৈরি করে প্রদর্শনী করে দিয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর শেষ বিশ্ব মেলাকে এক নতুন রূপ দিতে, Tagus নদীর মোহনার পাশে, ঐতিহাসিক লিসবন থেকে একটু দূরে, শহরের বাইরের এক বিশাল জায়গা, যেটা কিনা একসময় আবর্জনা, ময়লা ও শহরের সমস্ত জঞ্জাল ফেলার জন্যেই ব্যবহার হোতো, সেই জায়গা নির্বাচিত হল – অনেকেই ভেবেছিল ঐ জঞ্জালের মধ্যে – যেখানের আবহাওয়া দূষিত, মাটি দূষিত, জল দূষিত সেখানে কিছু করা অসম্ভব।
কিন্তু, পৃথিবীতে সব দেশেই কিছু মানুষ থাকে যারা ‘অসম্ভব’ কথাটির ‘অ’ অক্ষরটি বাদ দিয়েই কাজ করতে ভালোবাসে। পিশাচ তাড়িত সেই সব মানুষেরা অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে ও সেই স্বপ্নকে তাড়া করতে ভয় পায় না। ফলে, Tagus নদীর মোহনায় লিসবনের সেই বিশাল জঞ্জাল যুক্ত দূষিত জায়গায় বিশ্ব প্রদর্শনীর জন্যে তৈরি হয়ে যায় – Parque das Nações মানে পার্ক দে নাসোজ, এক আধুনিক লিসবনের জন্ম হয়। অত্যাধুনিক লিসবনের এই অঞ্চল পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়ে দেয় কি ভাবে প্রকৃতির সমস্ত উপাদান – জল, মাটি, হাওয়া নির্মল রেখেও শহর তৈরি হয়।
বিকেলের দিকে জলের ধার ঘেঁসে বাঁধানো রাস্তা ধরে বহুদূর হাঁটা যায়। নদীর ধার ঘেঁসে রাস্তার উপর দিয়ে চলে গেছে রোপ ওয়ে। দূরে, দেখা যায় আধুনিক ভাস্কো দা গামা ব্রিজ ও টাওয়ার। সন্ধ্যা হতেই ব্রিজের আলো জ্বলে ওঠে, জ্বলে ওঠে নদীর ধারের ভাস্কো দা গামা টাওয়ারের আলো, এখানের আকাশ রেখায় রাজত্ব করে এরা – এক অদ্ভুত ছবি তৈরি হয়। মাঝ জুলাইয়ের সন্ধ্যার জলো বাতাসে একটু হিমের ছোঁয়া পাই। ভালো লাগে এই নির্মল আধুনিক শহরের পথে হেঁটে যেতে।
নদীর ধার ঘেঁসে সারি বাঁধা রেস্টুরেন্টে পৃথিবীর সমস্ত দেশের রান্নার খোঁজ পাওয়া যায়। তাই, হাঁটতে হাঁটতে যেখানেই জিরনোর ইচ্ছা হয় – পাশের রেস্টুরেন্টে সেরে নেওয়া যায় চট জলদি খাওয়া দাওয়া।
বিংশ শতাব্দীর শেষ বিশ্ব প্রদর্শনী করেই কিন্তু এই অঞ্চলের অগ্রগতি থেমে থাকে নি। আজও এখানে সারা পৃথিবীর নানান কনফারেন্স, মিটিং অনুষ্ঠিত হয়, তাই এই অঞ্চলে নানা দেশের নানা ধরণের মানুষের প্রচুর আনাগোনা, আর সেই আনাগোনা ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রচুর নামী, দামী হোটেল ব্যাবসা, পর্যটন শিল্প। গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন, আকাশ চুম্বী জোড়া অট্টালিকা São Gabriel ও São Rafael। তাছাড়া, ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইনডোর সামুদ্রিক aquarium বা Oceanarium এখানেই আছে – বিশ্ব প্রদর্শনী উপলক্ষ্যেই তৈরি হয়েছিল।
এক সময় যেখানে ছিল দুর্গন্ধময় জঞ্জালের ঢিপি, আজ এই অত্যাধুনিক লিসবনের পার্ক শহরে চলার পথে মনে হতেই পারে – পৃথিবীতে বোধহয় ‘অসম্ভব’ বলে কথাটি কোন এক আপেক্ষিক কথা, কারোর কাছে যা অসম্ভব, অন্য জনের কাছে সেটা সম্ভব।
পৃথিবী মানুষকে না চাইতেই যা দিয়েছে – আকাশ, আলো, জল, বায়ু, মানুষ একসময় তা অকাতরে দূষিত করে গেছে, পৃথিবীকে জঞ্জালময় করে গেছে। আবার মানুষই, পৃথিবীর সমস্ত জঞ্জাল সরিয়ে এই পৃথিবীকে আগত প্রজন্মের জন্যে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তাই, আজ এই অঞ্চল আধুনিক স্থাপত্য ও সবুজ প্রকৃতি-শহরের সহাবস্থান শেখার এক পাঠশালা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সহাবস্থান দেখার জন্যে, অনুভব করার জন্যে লিসবনে এলে একবার এই অঞ্চল সবাই দেখে যায়।