জুলাই আগস্ট মাসে গরমের রোদ্র দগ্ধ তপ্ত দিনের শেষে গারন নদীর বুক ছুঁয়ে আসা এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার নেশায় তুলুসবাসীরা অনেকেই Pech-David এর বিশাল টিলা-পার্কে আসে। শুধু কি গরম, শীতের রোদের উত্তাপ নিতে, সবুজের ঘাসের পথ ধরে হাঁটতে, দৌড়তে, বারবি কিউ করতে, নীল আকাশে ঘুড়ি ওড়াতে, কিংবা শুধুই নির্জনে একটু সময় কাটাতে, ছোট খাটো পিকনিক করতে অনেকেই ভিড় করে এখানে। খোলা মেলা বিশাল এই পার্ক – প্রায় দুশো আশি হেক্টর জমি নিয়ে তৈরি এই সবুজ জায়গা। দৈনন্দিন জীবনের এক ঘেয়েমি থেকে সবুজ প্রকৃতির কোলে এক উদার মুক্তির হাতছানি এখানে।
আমাদের রামন ভিলের বাড়ীর ঠিক পাশেই এই বিশাল টিলা-পার্ক। বেলকনি থেকেই দেখা যায় ঐ টিলার শ্যামলিমা। প্রায় দিনই তাই প্রকৃতির কাছাকাছি কিছু সময় কাটাতে ঐ পার্কের সবুজ আঁকাবাঁকা জঙ্গুলে পথে হাঁটি। কখনো বা শীতের ছুটির পুরো বিকেলই পার্কের খোলা আকাশের নীচে বসে রোদের উত্তাপ নিয়ে বই পড়তে পড়তে কেটে যায়। শহরের এই খোলা মেলা জায়গায় দেখি এখানের মানুষের মুক্তির স্বাদ। কাছেই বাবা ও ছেলে মিলে একটা বড় ঘুড়িকে আকাশে ওড়াতে ব্যস্ত, কিংবা হয়তো কেউ বারবি কিউের জন্যে কয়লার আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত – নাকে ধোঁয়ার গন্ধ আসে।
এই Pech-David পার্ককে যে কত রকম ভাবে দেখেছি, প্রথম থেকেই আমাদের তুলুস বসবাস কালের বহু মুহূর্তের সাক্ষী এই Pech-David । তুলুসের কতো রক্তিম সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়েছি এই টিলা পার্কে দাঁড়িয়ে। কখনো দেখেছি এর তুষার আবৃত ধবল রূপ, শীতে রুক্ষ নিঃস্ব রিক্ত বৈরাগী রূপ, আবার পাতা ঝরার দিনে দেখেছি রঙিন পাতার সাজে সজ্জিত এই পার্ক। শীতে পার্কের গাছ গুলোর নিঃস্ব, রিক্ত, রুক্ষতায় এই পার্ক একদম নির্জন হয়ে পড়ে। শীতের বিকেলে পার্কের ধূসর পথে চলতে চলতে কখনো কেমন এক অদ্ভুত একাকীত্ব বোধ ঘিরে ধরে। কোন কোন দিন আবার দুরন্ত দামাল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় আমার অস্তিত্বকে।
একবার মনে হল পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় এই টিলা-পার্ক থেকে তুলুসকে কেমন লাগে দেখবো – সেই পূর্ণিমার রাতে মাঝ রাত পর্যন্ত খোলা আকাশের নীচে কাটিয়ে এক অপূর্ব পূর্ণিমা রাতের সাক্ষী হয়েছিলাম। আকাশ সেদিন খুবই পরিষ্কার ছিল – ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর, দূরে যে কয়েকটা ল্যাম্প পোস্টের আলো জ্বলছিল, তারাও যেন চাঁদের আলোর কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের পথে জ্যোৎস্নার মায়াবী আলো সৃষ্টি করেছিল এক আলো ছায়ার মোহ।
এখানে এলে এই উঁচু জায়গা থেকে দেখা যায় তুলুসের আকাশ রেখা। দিনের শেষে আমাদের কত বিকেলই কেটেছে তুলুসের বুকে আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়। এখানের নির্জনতায় বসে নিজের মুখোমুখি বসে বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে – দূরে তুলুসের প্রতিটি আলো ঝলমল করে জ্বলে ওঠে – অপূর্ব ছবি তৈরি হয়। অন্ধকার ঘনায়, জীবনের এক দিন খরচ হয়ে যায় – টিলা থেকে নামার ঢালু পথে হাঁটতে হাঁটতে ফেরার পথ ধরি। মনে হয়, নির্জনতা মানুষকে অনেক কিছু শেখায় – মনে পড়ে, ছেলেবেলায় আমার এক শিক্ষক বলতেন, প্রতিদিন মানুষকে কিছুক্ষণ নির্জনে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, আর সেই নির্জনতা প্রকৃতি ছাড়া ভালো আর কে দিতে পারে।