ফরাসী চলতি হাওয়ার পন্থী (Galeries Lafayette, Paris)

তুলুস বা প্যারিসের মেট্রোয় যেতে যেতে সামনে বসা ফরাসী মহিলার ঢাউস ব্যাগে কি কি থাকতে পারে ভেবে অবাক হই। কি নেই! তুলুসের মেট্রোয় প্রায়ই দেখি অফিস যাত্রী ফরাসী মেয়েরা মেট্রোয় চেপে যুত করে বসে ছোট্ট ক্রিমের বোতল বের করে হাতে মেখে, চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে, ব্যাগের ভেতর থেকে খবরের কাগজ বা অর্ধেক পড়া বই ও আধ খাওয়া ফ্রেঞ্চ বাগেত স্যান্ডউইচ বের করে কামড় দিতে দিতে মেট্রো যাত্রার সময় কাটিয়ে দেয়। কেউ বা গান শুনতে শুনতে শুধুই নামার ঠিক আগে, ব্যাগ থেকে ছোট্ট মেক আপ কিট বের করে একটু প্রাসাধনও সেরে নেয়।

ফরাসী মেয়েরা মনে হয় ব্যাগের এই চলতি সংসারে সমস্ত দরকারি জিনিসই খুবই গুছিয়ে রাখে। মেট্রোয় সেদিন, আমার পাশের এক ভদ্রমহিলা এক বোতল ওয়াইন কিনে ফিরছিলেন। কোথাও ঠোকা লেগে বোতলটি ভেঙ্গে যায় ও মহিলার হাত কেটে রক্ত ঝরতে শুরু হয়, পাশের আরেক ভদ্রমহিলার ঢাউস ব্যাগ থেকে দেখি নিমেষে, ব্যান্ড এড বেরিয়ে পড়ল, তাড়াতাড়ি ব্যান্ড এড এগিয়ে দিলেন।

যাইহোক, ফরাসী মহিলারা নাকি ওদের এই ব্যাগ গুলো খুবই দাম দিয়ে কেনে। ওরা বলে – এ শুধু স্টাইল নয়, অনেকটা গাড়ি কেনার মতোই। টেঁকসই এই ব্যাগ গুলো সারাজীবন ব্যাবহার করে শেষে নিজের নাতনীকেও দিয়ে যেতে পারে ওরা।

সবাই জানে ফ্রান্স মানেই ফ্যাশন, পারফিউম, ওয়াইন – পৃথিবীর সমস্ত বিলাস দ্রব্যের স্বর্গ রাজ্য আর কি। আমিও তাই জানতাম, ফ্রান্সে আসার আগে। ভেবেছিলাম প্যারিসের পথে হয়তো শুধুই দেখবো উদ্ভট পোশাকের ফ্যাশন সচেতন জনতা। কিন্তু, অদ্ভুত ভাবে দেখি ফ্রান্সের বেশীর ভাগ মানুষ ফ্যাশন সচেতন নয়, ওরা স্টাইল সচেতন। খাঁটি ফ্রেঞ্চদের জীবন ধারনের, পোশাকের, জিনিস পত্র ব্যবহারের এক নিজস্ব দীর্ঘ স্থায়ী স্টাইল আছে। হয়তো, সেই স্টাইল তৈরি করে দেয় কোন নামী ফরাসী কোম্পানির খাঁটি আনুষঙ্গিক গুলো।

রুচি সম্পন্ন ফরাসী মহিলাদের দামী ব্যাগের দায়িত্ব যেমন নিয়েছে – লুই ভিতন, লং চ্যাম্প, লেন্সার, লেঙ্কেস্টার – আরও কতো ফরাসী কোম্পানি। আর সমস্ত কোম্পানির ফ্যাশন ও স্টাইলকে এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছে গ্যালারী লাফায়েতে(Galeries Lafayette), অবশ্য লুই ভিতন (Louis Vuitton) ছাড়া।

বিগত দেড়শ বছর ধরে লুই ভিতন ফ্রান্স সহ পৃথিবীর সমস্ত দামী ফ্যাশন ও স্টাইলের সাক্ষর হিসাবে পরিচিত, ফরাসীদের কাছে লুই ভিতন ব্যাগ শুধু ব্যাগ নয়, ওদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের এক অঙ্গ। লুই ভিতনের নিজস্ব শো রুমে প্রমান সাইজের ব্যাগ দেড় হাজার ইউরো থেকে শুরুই হয়।

যাইহোক, গ্যালারী লাফায়েতে তো শুধু এক দোকান নয়, যেন পৃথিবীর সমস্ত বিলাসিতার এক ছোট খাটো শহর, এখানে ঢুকে অনায়াসে হাজার ব্র্যান্ডের স্টাইল ও ফ্যাশনের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া যায়।

প্যারিসের গ্যালারী লাফায়েতে ১৮৯৫এ শুরু হয়েছিল, La Fayette রাস্তার কোণের এক ছোট্ট দোকান ঘর থেকে। পরে, ওরা সেই রাস্তার এক নম্বর বিল্ডিং কিনে নেয়, ধীরে ধীরে প্যারিসের বুলেভার্ড Haussmann এর কয়েকটা বিল্ডিং কিনে নেয় ও তৈরি হয় ফ্রান্সের এই বিশাল ফ্যাশন হাউস।

প্যারিসে এসে প্রচুর টুরিস্ট একবার গ্যালারী লাফায়েতে দেখে যায়, বিশেষ করে যদি ক্রিসমাস বা নতুন বছরে কেউ প্যারিসে থাকে, বুলেভার্ড Haussmann  এর গ্যালারী লাফায়েতে ও অন্যান্য ফ্যাশন হাউসের আলোক সজ্জা না দেখে ফেরে না। ক্রিসমাসের সময় যদিও গ্যালারী লাফায়েতে বন্ধ থাকে, কিন্তু, শুধু উইন্ডো সজ্জা দেখতেই প্রচুর ভিড় হয়।

অন্য সময় প্যারিসের গ্যালারী লাফায়েতে-তে প্রতি সপ্তাহে ফ্যাশন শো হয় শুধুমাত্র টুরিস্টদের জন্যে – বিনামূল্যে! গ্যালারী লাফায়েতে অতি সন্তর্পণে বিশ্বের খোলা বাজারকে এড়িয়ে নিজেদের এক নিজস্ব ফ্রেঞ্চ মান বা উৎকর্ষ বজায় রাখার চেষ্টা করে। বর্তমানে ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গার এই ফ্যাশন হাউস যেন ফরাসীদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতির এক অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্যারিসের বা ফ্রান্সের শহরের পথে চলার পথে, ফরাসী মানুষের ফ্যাশন ও স্টাইলের বন্ধনহীন গ্রন্থির ছোঁয়াচ পেতে হলে, একটু ফরাসী সুরভির সৌরভে মাততে হলে – অতি অবশ্যই গ্যালারী লাফায়েতের বিশাল দরবারে একবার আসা উচিত।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Europe, France, Travel and tagged , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s