অফিসের জানালা দিয়ে শেষ দুপুরের কেমন এক মন খারাপ করা কাঁচা হলুদ রঙের হেলানো রোদের আলো ও তার দীর্ঘ ছায়া, তেড়ছা এসে আমার ডেস্কে পড়েছে – দেশ থেকে বহু দূরে ফ্রান্সে, অথচ এই সময়ে এখানের রোদের কাঁচা সোনা রঙে, ঝকঝকে উজ্জ্বল দিনে, নীল আকাশে ভাসমান পেঁজা তুলো মেঘের সজ্জায়, হালকা শীত শীত বাতাসে, প্রকৃতির সেজে ওঠা দেখে অন্তরাত্মা দিয়ে অনুভব করি – মা আসছেন। মায়ের আগমনী সুরে জেগে উঠেছে প্রকৃতির বীণা। শেষ বিকেলের মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ায় বুঝি বা ভেসে আসছে মায়ের আঁচলের শিউলি ঝরা সৌরভ।
এখানে প্রকৃতির এই সাজো সাজো ছন্দে হৃদয় নিংড়ে যায় চিনচিনে এক অচেনা বেদনায়। কত দিন দেশ ছাড়া, ঘর ছাড়া, কত দিন দেশের পুজো দেখিনি, দেখিনি নতুন কাপড়ে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠা হাজার মানুষের উজ্জ্বল হাসিখুশি মুখ, শুনিনি আগমনী গানের সুর, ঢাকের মন কেমন করা দ্রিদিম দ্রিদিম আওয়াজ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে কত কি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঘুম ঘুম ভোরে বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের গলায় মহালয়া শোণার দিন, হারিয়ে গেছে ছেলেবেলার সেই কুয়াশা ঘেরা, শিউলি ঝরা, শিশির ভেজা শরত সকাল। মনে পড়ে, পুজোর ছুটিতে সারা সকাল শিউলি কুঁড়িয়ে পাড়ার পুজো মণ্ডপে নিয়ে যাওয়ার কথা। মনে পড়ে, নতুন কাপড়ের কোরা গন্ধে পুজোর গন্ধ মিলেমিশে যাওয়ার কথা।
পুজো আসার অনেক আগেই আনন্দমেলা থেকে শুরু করে সমস্ত পুজো সংখ্যা চলে আসতো বাড়ীতে। আমার কাছে পুজো মানে ছিল ঢাকের ছন্দে ছন্দে সব পেয়েছির দিন, হাসি আনন্দের দিন, খাওয়া দাওয়ার দিন, সোনালি দিন, ভালো লাগার দিন।
ছেলেবেলায় আমার কাছে পুজো মানে মণ্ডপে মণ্ডপে ঠাকুর দেখা তো ছিলই, তাছাড়া সকাল সকাল স্নান সেরে সরকার বাড়ীর পুজো দেখতে যাওয়াও ছিল আমার পুজোর অন্যতম এক আনন্দ। পুজোর নাটক,গান, যাত্রা, পালা গান ছিল আমার পুজোর দিনের আনুষঙ্গিক আনন্দ। মনে পড়ে, শারদোৎসবের নাটকের জন্যে বহুদিন আগে থেকেই পরিকল্পনা শুরু হত, রিহার্সালে কত বিকেল থেকে সন্ধ্যা যে কাটিয়ে দিতাম – সবই কেমন করে যেন মিলিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। জীবন এখন বড় বেশী কেজো, বাস্তব হয়ে উঠেছে।
এখন পুজোর দিন গুলো যদি কাজের হয়, তাহলে তো কাজ নিয়েই কেটে যায়। পুজোর উইকেন্ডে তুলুসের হাতে গোণা বাঙ্গালীদের এক ছোট্ট জমায়েত হয়, খাওয়া দাওয়া হয় কিংবা কারোর বাড়ীতে মায়ের ফটোতেই পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে অষ্টমী বা নবমীর পুজো সারা হয় আমাদের। তুলুসের বসার ঘরে বিকেলের জমায়েতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মানস চোখে যেন দেখি উজ্জ্বল আলো দিয়ে সাজানো মায়ের মন্ডপের পথে হাজার মানুষ নতুন কাপড়ে হাসিমুখে চলেছে – নিজেকে কেমন যেন এক দলছুট বলে মনে হয়, বিষণ্ণ হই।
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বরাক নদের তীরে এক শান্ত মফঃস্বল শহরে। পুজোর আগে নদের ওপার থেকে কুমোর পাড়া থেকে জোড়া নৌকোতে করে মায়ের মূর্তি নিয়ে আসা হত শহরে। এক শরত দুপুরে বরাক নদের বুকে নৌকোতে দেখেছিলাম, মাকে নিয়ে আসছে কুমোররা। নৌকোয় ভরা নদের বুকে তর তর করে এগিয়ে আসা মায়ের মৃন্ময়ী রূপে কাঁচা হলুদ, সোনা রোদ পড়ে কেমন এক অপূর্ব ছবি তৈরি হয়েছিল – সে ছিল এক আনন্দের ছবি, আশার ছবি, উৎসবের ছবি, ভরসার ছবি। বরাকের উপরে মায়ের আগমনের সেই ছবি আমি যেন আমার অবচেতন মনে গেঁথে নিয়েছি, সেই রূপ আমি কোনদিনও ভুলি নি, ভুলবোও না। মা আসছেন – ভাবলেই মানস চক্ষে ভেসে ওঠে সোনালি দিনে বরাক নদের বুকে মায়ের সেই প্রকৃত আগমনের দৃশ্য।
ছেলেবেলায় নবমীর সন্ধ্যা আরতির পরেই কেমন এক বিচ্ছেদ বেদনায় মন মুচড়ে যেত। মনে হত, এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল পুজোর দিন? বেদনা কাতর হৃদয় বলে উঠত ‘এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না।’ নবমী আরতির ধোঁয়ার আড়ালে ভেসে ওঠা মায়ের মুখেও যেন দেখতাম এক মনখারাপের ছোঁয়া। তাঁর জ্বলজ্বলে চোখে কি জলও দেখেছিলাম? হয়তো। দশমীর সকালে ঢাকিরাও যেন বাজাতো মন খারাপ করা বিদায়ের এক উদাসীন তাল। দশমীর বিকেলে উদাস হাওয়ায় যেন ভাসতো মনখারাপের রেনু।
প্রতি বছর জল ভরা চোখে মাকে বিদায় জানতাম – আবার আসিস মা ফিরে। এখন আমি থাকি দূর দেশে, যে দেশে তোর দেখা পেতে যেতে হয় অনেক দূর। তবু মা, হৃদয় দিয়ে, অন্তঃরাত্মা দিয়ে আকাশে বাতাসে তোর আগমন বার্তাকে অনুভব করতে করতে ছেলেবেলার স্মৃতি ঘেরা তোর পুজোর স্মৃতি সম্বল করেই পুজোর দিন গুলো কেটে যায়।