ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে, চলে যাবো, কাল। আরও ছোট ছোট অনেক কিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও গুটিয়ে নিচ্ছি, গুছিয়ে নিচ্ছি, সেই জায়গাটা থেকে। কিছুদিন, হেলসিঙ্কির ঐ হোটেল এপার্টমেন্টে থাকতে থাকতে যেন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল – প্রতিটি দিন যেন আবিষ্কারের দিন ছিল।
নতুন দেশে, নতুন পথে, যা কিছু নতুন, সবই অবাক করে, বেড়াতে এসেছি, দেখতে এসেছি, তাই যা কিছু দেখি কৌতূহল বজায় থাকে – নতুন জায়গাকে যেন পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করে নিয়ে, যত্ন করে মনের ভাঁড়ারে রেখে দিই।
মোড়ের মাথায় এক লাইল্যাক ফুলের ঝোপে থোকা থোকা সাদা ফুল ফুটে ছিল – নিজেকে সেই সুন্দর থেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম, ঐ লাইল্যাক ঝোপের ফুল গুলো আর কোনদিনও দেখতে ফিরবো না এখানে। শেষবারের মতো মোড়ের ঐ কফির দোকানের সুবাস বুক ভরে টেনে নিয়ে, কফির কাপে চুমুক দিয়ে, কফির দোকানের স্থানীয় গুঞ্জন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি।
কোন এক জায়গায়, যাই, ও সেখানে কিছুদিন থেকে চলে আসার আগে ঐ যে গুটিয়ে নেওয়ার, গুছিয়ে নেওয়ার এক অনুভূতি – তা যেন এক হালকা চিনচিনে ব্যথার জন্ম দেয়, আবার এক আনন্দেরও জন্ম দেয় – মিশ্র এক অনুভূতি।
আনন্দ – নতুনকে বরণ করা বা পুরনোকে আবার ফিরে পাওয়ার আনন্দ।
ব্যথা – ছেড়ে আসার। ফিরবো না, আর কোনদিনও ফিরবো না এখানে – একবারই এসেছিলাম, দেখেছিলাম – এবার চলে যেতে হবে।
সেই সেবার যখন সেভিলে ছিলাম, ফেরার আগের দিন রাতে, ঘুমের ঘোরে যেন শুনছিলাম ঘোড়ার গলার ঘণ্টির রিনরিনে আওয়াজ ও খুড়ের খট খট আওয়াজ – সেই আওয়াজে, সেই দিন ঘুমের ঘোরেই যেন চলে যাওয়ার তীক্ষ্ণ এক বেদনা অনুভব করেছিলাম।
সেই জায়গার দিন যাপনের থেকে গুছিয়ে নিয়ে, গুটিয়ে নিয়ে, সঙ্গে নিচ্ছিলাম একরাশ স্মৃতি, একরাশ সোনালি দিন, আলো, মুক্তি, পথ চলার গল্প।
আর যে কোনদিনও এখানে ফিরবো না, যদিও ফিরি, কিছুই এক রকম থাকবে না, আমি বদলে যাবো, সময় বদলে যাবে – এই অনুভূতি যেন মাঝে মাঝে হৃদয় নিংড়ে দেয়।
এক এক জায়গায় যাওয়া, থাকা – সে হোক না যতই কম দিনের জন্যে, দেখা, সেই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া, গুটিয়ে নেওয়া – এক জীবন বোধের জন্ম দেয়, শিক্ষা দেয়, বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হই। তাই থাকার, বাঁচার প্রতিটি মুহূর্তকে অনুভব করার চেষ্টা করি। আর তাই বোধহয়, ভ্রমণকে শিক্ষার অঙ্গ বলা হয়।