মাঝে মাঝে ‘গ্লোবালাইজেশন’ শব্দটির সঙ্গে খোলা বাজার বা ‘ফ্রি মার্কেট’ কথাটি বড্ড গুলিয়ে যায়। গত দু’শো বছর আগে ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ও জাপানিজরা যা করেছিল – গ্রাম ছেড়ে দিয়ে শহরে গিয়েছিল, পুরনো ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে নতুন তৈরি করেছিল – শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল – আর সেই শিল্প বিপ্লবের ফলেই গ্লোবালাইজেশন হয়েছিল।
কিন্তু, গ্লোবালাইজেশন মানে শুধু যে ব্যবসা বানিজ্যের অবাধ বিচরণ, ব্যবসার আদান প্রদান তা নয়, গ্লোবালাইজেশনের কথা ছিল শুধু ব্যবসা বানিজ্য নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষ, স্কিল, বুদ্ধি, ইনফরমেশন, সামাজিক ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সঙ্গীত, শিল্প – সব কিছুর আদান প্রদান হবে – ইন্তারচেঞ্জ, এক্সচেঞ্জ। আসা যাওয়া, ভালো থাকা, সবাইকে নিয়ে চলা, এগিয়ে চলা।
বলা যায়, মানুষের যে কোন স্থানীয় ঘটনাকে বিশ্ব রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে – এর চেয়ে সহজ ভাষায় বোধহয় গ্লোবালাইজেশনকে ব্যখ্যা করা যায় না।
তাছাড়া, গ্লোবালাইজেশনের থিয়োরির পেছনে আরও এক মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, যে সময়ে প্রথম বিশ্বের বুদ্ধিজীবী, ব্যবসাদার ও রাজনৈতিক এলিটরা গ্লোবালাইজেশনের স্বপ্ন দেখেছিল – তাদের মাথায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের স্মৃতি একদম টাটকা ছিল।
ওরা ভেবেছিল, যদি সমগ্র বিশ্ব একই সিস্টেম হয়ে যায় – বিশ্ব গ্রাম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে একে ওপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়, পৃথিবীর সমস্ত দেশ গুলোর অর্থনীতির সঙ্গে সেতু গড়ে দেওয়া যায় – তাহলে, হয়তো আর পরের বিশ্ব যুদ্ধ হবে না। এমনকি, কোন যুদ্ধই হবে না, সমস্ত পৃথিবীর জীবন যাপনের মান উন্নত হবে।
বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। কিন্তু, প্রথম বিশ্বের যে কোন আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিঙে বসে যে থিয়োরির জন্ম হয়েছিল – বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে সেই থিয়োরির ব্যবধান ছিল অনেক অনেক বেশী।
গ্লোবালাইজেশনের যে এক নেগেটিভ দিকও থাকতে পারে, তা ঐ এলিটরা কল্পনাও করতে পারে নি। সভ্যতা সবসময়েই এলিটরা তৈরি করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু, এলিটদের প্রবনতা একটাই – এক আইডিয়াল সিস্টেম কল্পনা করা। আর সেই আইডিয়াল সিস্টেমের মানুষ জন খুবই কম থাকে – এতে কিছু মানুষের লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু, অধিকাংশ মানুষ সিস্টেমের বাইরেই রয়ে যায় – আর যারা বাইরে রয়ে যায়, তারাও সিস্টেমকে বদলে দিতে পারে।
যাইহোক, প্রথমে যতদিন এক শ্রেণীর ব্যবসাদারদের মুনাফা হয়ে চলেছিল – সবাই গ্লোবালাইজড পৃথিবীর জয়গান গেয়েছিল।
কিন্তু, যখন চীন দেশের সঙ্গে উন্নত ও প্রথম বিশ্বের ব্যবসা বানিজ্যের সংযোগ স্থাপন হল – গ্লোবালাইজেশনের সংজ্ঞাটাই যেন বদলে গেল – হয়ে উঠল চৈনিক গ্লোবালাইজেশন। চীন যেন বুঝে গিয়েছিল – এই গ্লোবালাইজড সিস্টেমের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারলে ওদের অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগবে।
তারপর, ইউরোপে ও আমেরিকার বাজারে সস্তা চৈনিক জিনিস পত্রের সুনামিই এলো, বলা যায়। আমরাও দেখেছি, ইউরোপের বাজারের আলপিন থেকে শুরু করে ঘর তৈরির জিনিস পত্র, এমনকি গুড়ো দুধ পর্যন্ত – সবই চীন সরবরাহ করে, কেন? না, চীন বহু সস্তায় ঐ জিনিস গুলো তৈরি করে, সরবরাহ করতে পারে। অবশ্য, গুড়ো দুধে প্লাস্টার অফ প্যরিসের গুড়ো পাওয়ায় ফ্রান্স, অনেক আগেই চীন থেকে গুড়ো দুধ আমদানি বন্ধ করেছিল।
ইউরোপের বাড়ীর মেঝে তৈরির জন্যে যে কাঠের পাটাতন লাগে। তা ইউরোপের গাছ কেটে জাহাজে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, চীনে। তারপর, চীন সেই কাঠ চিরে, পালিশ করে পাটাতন বানিয়ে আবার ইউরোপে পাঠায়।
শুধু, কি কাঠের পাটাতন! কাপড় সেলাই থেকে শুরু করে, নামী ব্র্যান্ডের জিনস্, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র সবই চীন দেশে তৈরি হয় – কারণ একটাই – সস্তায় তৈরি করে বেশী দামে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা। ইউরোপে বা আমেরিকায় কোন জিনিস তৈরি করতে যা খরচ হয়, চীন সেটা দশগুণ বা আরও কম খরচে করে দিতে পারে। বর্তমানে, যখন চীনে তৈরি করতে জিনিসপত্রের খরচ বেড়ে যেতে শুরু করল – নামী ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র গুলো এশিয়ার আরও আরও অন্যান্য দেশে তৈরি হতে শুরু করল – যেখানে চীনের চেয়েও কম খরচে তৈরি করা যায়।
ম্যাপে চোখ রাখলেই দেখা যায়, ইউরোপে ও চীনের মধ্যের সমুদ্রের দূরত্ব, আর এই সমুদ্রের দূরত্ব জাহাজে করে পারাপার করতে কতটুকু প্রাকৃতিক সম্পদ, কয়লা, ডিজেল ইত্যাদির ব্যবহার হয়। আর দেখা যাচ্ছে গ্লোবালাইজেশনের জন্যে সমুদ্রের বুকে জাহাজ চলাচল বেড়ে যাওয়ার ফলে প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণীও আজ বিপন্নের মুখে।
অনেক গবেষকদের মতে, এই গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমে খুব কম সময়ের মধ্যে প্রকৃতির সীমিত পরিমাণের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ঐ গ্লোবালাইজেশনের এক তেতো ফল।
কিন্তু, প্রথম বিশ্বের দেশ গুলো গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্যে সর্বদা তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোকে দায়ী করে চলেছে – কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, এই গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমে, প্রথম বিশ্বের হাতে গোণা, সংখ্যালঘু কিছু মানুষের জীবন যাপনের মান উন্নত রাখার জন্যেই সবচেয়ে বেশী প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার হচ্ছে – সে জল থেকে শুরু করে পেট্রোল, ডিজেল সবই ওরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশী খরচ করে চলেছে।
সে তো গেলো সমুদ্রের প্রাণীদের কথা কিংবা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের কথা – কিন্তু, ইউরোপে বা আমেরিকায় যারা স্থানীয় মানুষ ঐ সমস্ত কাজ – যেমন সেলাই থেকে শুরু করে কাঠ চেরাইয়ের মতো কাজ গুলো করতো – তাদের কি হল?
প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে অনেকের মুখে বা মনে এলেও, সেই কথাটা ওরা চেপে রাখতেই পছন্দ করছিল। গ্লোবালাইজেশনের আদর্শে বিশ্বাস করেছিল – কারণ ইউরোপের বয়স্ক জেনারেশনের কাছে যুদ্ধের স্মৃতি টাটকা ছিল। কিন্তু, যখন পরবর্তী প্রজন্ম এসে চোখের সামনে দেখতে পেল, সেই জেনারেশনের হাত থেকে কাজ গুলো সব অন্য দেশে চলে যাচ্ছে, ওদের কাছে কোন ছোট খাটো ইন্ডাস্ট্রির কাজও নেই – তাই ধীরে ঐ গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমের প্রতি ওরা যেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে ফেলেছে। বিশেষ করে ,যুবসমাজ উগ্র জাতীয়তাবাদকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
নিঃসন্দেহে, এই গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমে একদল মানুষের প্রচুর মুনাফা হয়ছে। কিন্তু, অনেক বেশী সংখ্যক মানুষ ঐ গ্লোবালাইজড বিজনেস সিস্টেমের বাইরে রয়ে গেছে – পরিস্কার এক কাঁচের দেওয়ালের বাইরে রয়ে গেছে – প্রশ্নটা তাদের নিয়ে। ইউরোপের ও আমেরিকার অনেক বেশী মানুষ তাই আজ নিজেদেরকেই প্রশ্ন করছে – আমাদের কি লাভ হল? ইউরোপের বাজারে দেখা যাচ্ছে, প্রচুর সস্তার জিনিস আছে, কিন্তু, মানুষ কিনতে পারছে না, হাতে টাকা নেই। এমনকি আমেরিকার বাজারেও জিনিস পত্র কেনা কাটিতে ঘাটা পড়েছে।
আর তাই, আজ প্রথম বিশ্বের দেশ গুলোতে দেখা যাচ্ছে – ন্যশালিজম। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে গেল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট মারী লা পেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে আসার ডাক দিয়ে, ফ্রান্সের মানুষকে, ফ্রান্সের সীমানা ফিরিয়ে দেওয়ার ডাক দিয়ে ইলেকশন ক্যাম্পেন করছে। বলা যায়, এক ইন্টারন্যাশন্যাল ন্যশনালিজম এর জন্ম দেখা যাচ্ছে।
আর আশ্চর্য জনক ভাবে এই গ্লোবালাইজড পৃথিবী দেখছে – পৃথিবীর উন্নত দেশ গুলোর অধিকাংশ মানুষ, যে নেতা গ্লোবালাইজেশন সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, গ্লোবালাইজেশনকে প্রশ্ন করছে, এর বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাকেই সমর্থন করে, তাকেই নেতা হিসাবে বেছে নিয়েছে।
শুধু, কি গ্লোবালাইজেশনকে চ্যালেঞ্জ জানানো? দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উপরেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। যার ফল দেখা গেল – ব্রেক্সিট, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ফ্রান্সও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাবে – ফ্রেক্সিট! কে জানে।
আর ইন্ক্লুসিভ সিস্টেমের প্রতি এই বিশ্বাসহীনতাই জন্ম দিচ্ছে, এক উগ্র ন্যাশনালিজম, উগ্র জাতীয়তাবাদ – সে আমেরিকা হোক বা ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশ হোক, কিংবা ইস্ট ইউরোপিয়ান দেশ হোক, মানুষ গ্লোবালাইজেশন ছেড়ে এসে ন্যাশনালিজমকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে।
আরও দেখা যাচ্ছে, তীব্র এই গ্লোবালাইজড সিস্টেম মানুষের মধ্যে এক ইন্ডিভিজুয়ালিজম এরও জন্ম দিয়েছে। মানুষ আরও বেশী করে তার সংস্কৃতি, তার ঐতিহ্য, ধর্ম, খাদ্য সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। আর আজও এই গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে সাদা, কালো, খয়েরি, গেরুয়া, সবুজ রং দিয়ে মানুষকে বিচার করার চেষ্টা বজায় আছে। যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদানের কথা হয়েছিল, যে সেতু বন্ধনের কথা হয়েছিল, তা যেন শুধুই খাতায় কলমে, আর আদর্শেই রয়ে গেল। গ্লোবালাইজেশন এখন উল্টো স্রোতে বইতে শুরু করেছে – যার ফল – ডি-গ্লোবালাইজেশন।
তাহলে, কি বহু বছর আগে সাহিত্যিকের সেই কথা – বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে – কথাটাকেই মেনে নিতে হবে? সেটাই পৃথিবীর মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়তি?