খেতে খেতে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে বোঝা যায় – দৃশ্য গুলো সরে সরে যাচ্ছে। আর টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটির জলও তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে জানান দেয় – এবার আমরা ঘুরতে শুরু করেছি। স্টারটার, স্যুপ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া শুরু করার সময়, নীচে একদম চোখের সামনেই ছিল সবরমতি নদী, রিভার ফ্রন্ট, নদীর উপরের এলিস সেতু।
দেখা যাচ্ছিল সেতুর উপর দিয়ে হাজার যানবাহনের ব্যস্ততা, তারপর একটু একটু করে দৃশ্য গুলো বদলে যেতে শুরু করেছিল – মেন কোর্স খেতে খেতে বুঝতে পারছিলাম, বুফ্যে খাবারের আয়োজন থেকে আমরা অনেকটাই দূরে সরে এসেছি।
আবার কাঁচের জানালার ঐ দিকে নজর রেখে দেখি – আরে, আগের সমস্ত দৃশ্যই তো বদলে গেছে, এবার চোখের সামনেই দেখি আহমেদাবাদ শহরের ব্যস্ততা, কংক্রিটের বিস্তার, উন্নত আহমেদাবাদের স্বপ্ন দেখা যাচ্ছে।
সবরমতি নদীর তীরে যে উঁচু বিল্ডিং – যা নীচ থেকে দেখে এক নজরে মনে হতে পারে জলের এক ট্যাঙ্ক, সেই বিল্ডিং অনেকেরই নজর কেড়ে নেয়। আসলে তা এক রেস্টুরেন্ট – Revolving tower restaurant, ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার এক সুন্দর নমুনা।
গুজরাটের তীব্র ভূমিকম্পে যেখানে বহু উঁচু বিল্ডিঙের গায়ে ফাটল ধরেছিল, সেখানে এই বিল্ডিং সমস্ত কম্পন সহ্য করেও দাঁড়িয়ে আছে – সেটাও এক আশ্চর্য।
বাইশ তলা বিল্ডিঙের সমান উচ্চতার এই বিল্ডিং-এর একদম উপরে এই রেস্টুরেন্টটি। খাওয়া দাওয়া শুরু হলেই রেস্টুরেন্টটি একটু একটু করে ঘুরতে শুরু করে, নীচে দেখা যায় আহমেদাবাদ শহর।
রেস্টুরেন্টটিকে দেখতে অনেকটা যেমন ঘুড়ির মতো, তেমনি এর দার্শনিকতাও ঘুড়ির মতো – পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বলতে ঐ লিফট।
এক দ্রুত গতিমান শহরের সমস্ত ব্যস্ততার উপরে, আকাশের কাছাকাছি বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে নিতে, একটু একটু করে ঘুরে দেখা – আহমেদাবাদ শহরের মানুষের জন্যে এই বিলাসিতার সুযোগ করে দেয় নীলকান্থ পতঙ্গ রেস্টুরেন্ট।
শুধু কি স্থানীয় মানুষ? বাইরে থেকে যারা আহমেদাবাদ শহরকে দেখতে যায়, আকাশের গায়ে, মেঘেদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারের বিলাসিতা থেকে তারাও বঞ্চিত হতে চায় না।
দুপুরের শুরুতেই শুরু হয়েছিল লাঞ্চ – এলাহি আয়োজন – মেক্সিকো, ইটালি, চীন, ভারত থেকে শুরু করে – খাওয়ার প্লেটেই পৃথিবী ধরা দেয়। খাওয়া দাওয়ার আয়োজনেই অনেকটা পৃথিবী ভ্রমণ হয়ে যায়। তবে সমস্ত পদই নিরামিষ – বাঙালি গোপনে একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বৈ কি।
সে যাইহোক, যখন ডেজার্ট খেতে শুরু করেছিলাম, শীতের দুপুরের ফিকে রোদের ছায়া তখন দীর্ঘ হতে শুরু করেছিল। আর এই উঁচু টাওয়ার রেস্টুরেন্টের দীর্ঘ ছায়া গিয়ে পড়েছিল সবরমতি নদীর বুকে। শেষ ডিসেম্বরেও শীতের নাম গন্ধও ছিল না।
আহমেদাবাদ শহরের পরিবেশের তাপমাত্রায় শীত তো বিন্দুমাত্র অনুভূত হয় না, এখানের মানুষের মনে ও ক্যালেন্ডারে শীত থাকে। তাছাড়া, প্রকৃতির শুষ্ক ভাব ও রোদের একটু নরম ভাব, দীর্ঘ ছায়া, একটু তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামা, জানান দিয়ে যায় শীত এসে গেছে। আর সেই মানসিক শীত কালই আহমেদাবাদ দেখার জন্যে অতি উত্তম সময়। আর সেই উত্তম সময়ের পথ ধরেই আহমেদাবাদ ভ্রমণ পর্ব শুরু হয়।