দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের মৃত্যু মিছিলের জায়গা, যেখানে মানুষের ইতিহাসের এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের রেশ এখনো রয়ে গেছে, সেই সময় যে জায়গার নাম শুনলেই মানুষের হাড় হিম হয়ে যেত, যে জায়গায় গেলে মানুষের বীভৎস পরিণতির ও অসহায়তার সত্যি গল্প শুনে অতীব এক বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে – সেই জায়গা কি ভাবে এক টুরিস্ট গন্ত্যব্যে পরিণত হতে পারে, তা সত্যি এক আশ্চর্য বিষয়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যে জায়গা গুলোয় নাৎসি বাহিনী প্রচুর মানুষের উপরে তাদের ঘৃন্য অমানুষিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের কেন্দ্র করেছিল, মৃত্যুর কারখানা তৈরি করেছিল, যে জায়গার আকাশ ধোঁয়ায় আছন্ন ছিল – দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই জায়গা গুলোকে ঘিরে সারা পৃথিবীর মানুষের মনে তীব্র এক কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল – মধ্য ইউরোপের সেই নাৎসি কেন্দ্র গুলোতে সত্যি কি হয়েছিল – তা জানার জন্যে পৃথিবীর নানা কোণের ইতিহাসবিদরা, সত্যান্বেষীরা, যারা হলোকস্টের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে গিয়েছিল, যারা নিজেদের পরিবার পরিজনকে হলোকোস্টে হারিয়েছিল – তারা দেখতে চেয়েছিল সেই ভয়ংকর জায়গা।
আর তারপর ধীরে ধীরে ইতিহাসের সেই বীভৎসতার স্মৃতি বয়ে বেড়ানো জায়গা দেখতে হাজির হয়েছিল সাধারণ মানুষ। না এই ভ্রমণ, মানুষকে আনন্দিত করে না, মুগ্ধ করে না, তবু মানুষ সেখানে যায়, অনেকটা ঠিক উটের কাঁটাগাছ চিবিয়ে খাওয়ার মতো ব্যাপার, রক্ত ঝরে অথচ কাঁটাগাছ চিবিয়ে খাওয়া চাই।
পোল্যান্ডের ক্রাকাও এর হোটেলে বেশীরভাগ টুরিস্টদের গন্ত্যব্য থাকে Auschwitz কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। প্রতি বছর প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ পৃথিবীর নানা কোণ থেকে ঐ কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প দেখতে যায়। আর সেই সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দিকেই নির্দেশ করে।
তাই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, নব্বইয়ের দশকে এক নতুন ট্যুরিজমের জন্ম হয়েছিল – হলোকস্ট ট্যুরিজম, বা ডার্ক ট্যুরিজম। বহু মানুষ প্রতিদিন হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে যায়, যে জায়গায় বহু মৃত্যুর কাহিনী জড়িয়ে আছে – নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প সেই জায়গা গুলোতে যায়, হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন গুলোকে দেখে – সেই ভ্রমণ মানুষকে কি দেয়, কোন অনুভূতিকে জাগ্রত করে। সেই নিয়েই এই ডার্ক ট্যুরিজম।
সাধারণত মানুষের ইতিহাসের প্রায় সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহের স্মৃতি চিহ্ন গুলোকে এতটা সাজিয়ে রাখা, কিংবা সংরক্ষিত করে রাখা হয় নি, যতটা সম্ভব সেই বেদনা দায়ক চিহ্ন গুলোকে মুছে দেওয়ার চেষ্টাই করা হয়েছে – কিন্তু হলকস্টের চিহ্ন, অত্যাচারের চিহ্ন ও নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলোকে যথেষ্ট যত্ন করে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। একে ঘিরে এক ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। সংবেদনশীল অনেকেই তাই প্রশ্ন তোলে – মানুষের ভয়াবহ ইতিহাসের চিহ্ন যে জায়গায় ভাসে, সেই জায়গা সাধারণ মানুষের জন্যে খুলে দেওয়া, এক টুরিস্ট গন্ত্যব্যে পরিণত করা ঠিক কতটা যুক্তিপূর্ণ?
আবার এটাও বলা হয় – গবেষণার জন্যে, কুখ্যাত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্যে – যাতে ভবিষ্যতে ঐ বিষয়ের আর পুনরাবৃত্তি হতে না পারে, তাই এই ডার্ক ট্যুরিজমের প্রয়োজন। তাই দলে দলে ছাত্র ছাত্রী, বয়স্ক মানুষ ঐ বিষণ্ণ জায়গায় যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার হলকোস্ট থেকে বেঁচে ফেরা কোন একজনের পরবর্তী প্রজন্মও হয় – এখানে এসে তার পূর্ব পুরুষের শেষ পরিণতির জায়গা দেখে বিষণ্ণ হতে আসে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসে।
ট্যুরিজম মানেই তো মনে হয় – খোলা নীল আকাশ, ঝকঝকে সোনালি দিন, উদার নীল সমুদ্রের হাতছানি – কিন্তু, মধ্য ইউরোপের এই জায়গা গুলোয় যে ধূসর মনখারাপের চাদর জড়িয়ে থাকে তাই ডার্ক ট্যুরিজমের বিষয় – কিংবা বলা যায় ডার্কেস্ট ট্যুরিজম।