নাঃ, কখনো কখনো, কোন কোন খাদ্য বা পানীয়ের স্বাদ এতোই মুখে লেগে থাকে – বার বার চাইলেও সেই স্বাদের পুনরাবৃত্তি করা যায় না, হয় না। যতই উপকরণ গুলো একই থাকুক না কেন, সেই স্বাদটি যেন কিছুতেই আর পাওয়া যায় না।
যেমন, লিসবন শহরে টাগাস নদীর তীরের এক কফি শপের বাইরের বারান্দার চেয়ারে বসে, রাত একটার সময়ে, এক কাপ পর্তুগীজ কফির স্বাদ কেমন করে যেন চেতনায় গেঁথে গেছে। কিছুতেই সেই রাতের পর্তুগীজ কফির স্বাদের পুনরাবৃত্তি করতে পারি নি। অবশ্য পরিবেশও হয়তো সেই স্বাদের সঙ্গে জুড়ে যায়। মাঝ রাতে টাগাস নদীর বুক ছুঁয়ে আসা ঠাণ্ডা ফুরফুরে হাওয়ায় যে এক শীত শীত শিরশিরে অনুভূতি ছিল – তাও তো সেই কফির স্বাদের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়েই যেন সেই রাতের পর্তুগীজ কফি তৈরি হয়েছিল।
ব্রাজিল থেকে আমদানি করা কফি পানের অভ্যাস পর্তুগীজরা বেশ ভালো ভাবেই নিজেদের জীবন যাপনের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছে। কফি পান করাটা পর্তুগীজদের কাছে ভীষণই এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা সেরে নেওয়া হোক, বন্ধুত্বের সূচনা হোক, বা ক্লান্তি কাটানো হোক, কিংবা ছুটির বিকেল কাটানো হোক – পর্তুগীজরা সমবেত ভাবে কফির কাপে চুমুক দিতে ভালোবাসে। আর দেখেছি পর্তুগীজরা রাতের দিকে কফি পান করতে ভালোবাসে। লিসবনের যে কোন ক্যাফেতে রাত এগারোটার পরেও আশ্চর্যজনক ভাবে ভিড় লক্ষ্য করা যায়। কফি পান করাটা যেন পর্তুগীজদের কাছে ব্যবসা ছাড়াও, এক শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
তাই লিসবনে বা পর্তুগালের যে কোন শহরে গেলে, যে কোন টুরিস্ট পর্তুগীজ কফির স্বাদ নিতে ভোলে না। পর্তুগালে নাকি নানা স্বাদের কফি পাওয়া যায় – আর সেখানে কখনোই কফির স্বাদ একই রকম হয় না। লিসবনে কফি যেমন ভাবেই অর্ডার দেওয়া হোক না কেন – রেস্টুরেন্ট অনুযায়ী কফির স্বাদ বদলে বদলে যায়।
সাধারণত লিসবনে কফি অর্ডার করলে – বিকা (Bica) কফি পরিবেশন করে – ছোট্ট কাপে কড়া এস্প্রেসো কফি – স্বাদটা একটু তেতোর দিকে, ফরাসীরা সেটা ভালোই বাসে। অবশ্য লিসবনে বিকা কফি ছাড়াও অন্য নানা ধরণের কফি পাওয়া যায়।
আমরা কফি বলতে বুঝি প্রচুর দুধ ও চিনি দিয়ে ঘন এক তরল পানীয়। আর আশ্চর্য হয়ে দেখি পর্তুগীজ কফির স্বাদেও আমাদের পছন্দের সেই স্বাদ। ঘন দুধ দিয়ে, বড় কাপে এস্প্রেসো কফি – Galão – আর ঘন ফেনার উপরে দারুচিনি মসলার গুড়ো ছড়ানো। কফি ও দারুচিনির সুবাস মিলেমিশে অদ্ভুত এক গন্ধ তৈরি হয়। ব্রাজিল থেকে আনা কফি বিন, ও অভ্যাস, ভারতবর্ষ থেকে আনা দারুচিনি, ইতালি থেকে আনা উন্নতমানের কফি গুড়ো করার মেশিন – সব দিয়ে তৈরি হয় পর্তুগীজ কফি, কফি সংস্কৃতি। একটি কফির কাপে যেন সারা বিশ্বের সুবাস মেশানো – একেই বলে বিশ্বায়ন, বিশ্বায়নের স্বাদ।