শিল্পীরা জানে, ঠিক কি ভাবে মানুষের নজর কেড়ে নিতে হয়, মানুষের চেতনাকে, স্বপ্নকে, কল্পনাকে, ভাবনাকে জাগ্রত করতে হয়, ছুঁতে হয় – আর সে যদি পাবলো পিকাসোর মতো মহান ও বিখ্যাত শিল্পী হয়, তা হলে তো সেই শিল্পী, যুগের পর যুগ ধরে মানুষকে ভাবায়, অবাক করে, মানুষের শিল্প চেতনাকে জাগিয়ে তোলে, ছুঁয়ে যায়।
বার্সিলোনা শহরের গথিক Quarter এর ঐতিহাসিক পথ ধরে চলতে গিয়ে হয়তো সেই কথাটি অনেকেরই মনে হতে পারে। বিশেষ করে পুরনো বার্সিলোনার গলি পথ যখন টুরিস্টদেরকে পিকাসো মিউজিয়ামের সামনে নিয়ে আসে, কিংবা Plaça de la Seu এ নিয়ে আসে, সেই স্কোয়ারের মধ্যমণি la Seu ক্যাথিড্রালটি যেমন সবার নজর কেড়ে নেয়, তেমনি ভাবে নজর কাড়ে বার্সিলোনার আর্কিটেক্ট কলেজ বিল্ডিঙের গায়ে আঁকা বিশাল ফ্রেস্কোটি।
পাবলো পিকাসোর আঁকা সেই ফ্রেস্কো বার্সিলোনা শহরের অন্যতম দর্শনীয়। খোলা আকাশের নীচে পিকাসোর আঁকা একমাত্র কাজ। গ্রাফিতি স্টাইলে আঁকা এই ফ্রেস্কো দেখে প্রথমেই মনে হয়েছিল কোন শিশু, খেলার ছলে আপন মনে এঁকেছে। হ্যাঁ, ফ্রেস্কোর দিকে নজর চলে গিয়েছিল সেই শিশু সুলভ সরলতার জন্যেই।
যাইহোক, যদিও পিকাসো জীবনের বেশীর ভাগ সময় ফ্রান্সে কাটিয়েছিলেন, কিন্তু, তার জন্ম ও কিশোর বেলার স্বপ্ন চারণের জায়গা ছিল স্পেন, বার্সিলোনা। তাই, পিকাসোর শিল্পী জীবনের নানা গল্প ছড়িয়ে আছে বার্সিলোনার গলি পথে। পিকাসোর জীবনকে বুঝতে, জানতে অনেকেই তাই বার্সিলোনায় আসে।
তাছাড়া, পাবলো পিকাসো তার কাছের বন্ধুর আত্মহত্যার পরে, জীবনে খুবই মনখারাপ সময় অতিক্রম করেছিলেন, আর সেই মনখারাপের সময়ে যে ছবি গুলো এঁকেছিলেন – তাতে নীল রঙের প্রাধান্য ছিল বেশী, তাই পিকাসোর জীবনের সেই সময়কে নীল সময় বা The Blue Period বলা হয়, সেই নীল সময়ের প্রায় সমস্ত ছবির প্রেরণা ছিল বার্সিলোনা শহর এবং তার মানুষ।
পিকাসোর সেই নীল সময়ের ছবির বিষয় ছিল স্পেনের গলি পথ থেকে শুরু করে নানা ধরণের মানুষ ও তাদের অভিব্যক্তি। পিকাসোর জীবনের সেই সময়ে, একই রঙে আঁকা ছবি গুলো যদিও খুব একঘেয়ে ছিল, তাই সেই সময়ে কোন ছবিই বিক্রি হয় নি – কিন্তু পরবর্তী কালে সেই নীল সময়ের ছবি গুলো শিল্প প্রেমী ও পিকাসো প্রেমীদের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল। সেই সময়ে তার আঁকা ছবিতে মানুষের অভিব্যক্তি গুলো সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য পেয়েছিল ।
স্প্যানিশ শিল্পী পিকাসো কিন্তু তার জীবনের শুরুর দিকের পেইন্টিং গুলো বাস্তবকে কেন্দ্র করেই এঁকেছিলেন, আর তার শিল্পী জীবনের শুরুর দিকের সেই ছবি গুলো ও Blue Period এর কিছু ছবি নিয়েই বার্সিলোনার পিকাসো মিউজিয়াম। আর এই মিউজিয়ামের বিশেষত্ব – পিকাসো বার্সিলোনা শহরকে তার সেই ছবি গুলো উপহার দিয়েছিলেন এবং পিকাসোর প্রাইভেট সেক্রেটারির সংগ্রহের ছবিও এখানে স্থান পেয়েছে। সম্ভবত বার্সিলোনার এই মিউজিয়াম পৃথিবীর একমাত্র মিউজিয়াম, যেখানে পিকাসোর আঁকা বাস্তবকেন্দ্রিক ছবির সংগ্রহ আছে।
তারপর, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পিকাসো যা দেখতেন তা আঁকতেন না – আঁকতেন, যা তিনি অনুভব করতেন – বিমূর্ত শিল্প। ছবি আঁকার প্রথাগত নিয়ম, যা তিনি শিখে বড় হয়েছিলেন, সেটাকে নিজেই ভেঙ্গে দিয়ে, নিজের এক নিয়ম, এক স্টাইল তৈরি করেছিলেন। কিউবিজমের জনক পিকাসো, সম্পূর্ণ এক নতুন ধরণের বিমূর্ত শিল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। পিকাসোর আঁকা বিমূর্ত পেইন্টিংকে ঠিক আলাদা করে বুঝে ওঠার ক্ষমতা যদিও আমার নেই, কিন্তু, স্পেনের মহান সেই শিল্পীর প্রতি কৌতূহল তো বরাবরই ছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় – পৃথিবীতে বোধহয় বিমূর্ততাই সবচেয়ে বেশী বাস্তব। বিমূর্ততাকে কেন্দ্র করেই মানুষ বাঁচে। মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যটাও হয়তো বিমূর্ত।
শেষ জীবনে পিকাসোর বেশীরভাগ আঁকায় শিশু সুলভ সারল্য দেখা গিয়েছিল – আর সেই শিশু সুলভতাই ফুটে উঠেছে বার্সিলোনা শহরের ঐ ফ্রেস্কোতে। শিল্পীর বয়স যখন কম ছিল – আঁকা ছিল পরিণত, গভীর মন খারাপের সময় হয়ে গেল নীল, আর শেষ জীবনে শিশুর মতো সরল। শিল্পীকে ও তার সৃষ্টিকে বোঝা বড়ই কঠিন। ওদের মনের গঠন, শিল্পের ধরণ, সবই খুবই আলাদা – যা কিনা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝে ওঠে না। ওদের সৃষ্টি দেখে শুধু মুগ্ধ হতে পারি। আর সেখানেই বোধহয় শিল্পী ও শিল্পের সার্থকতা – যা কিনা যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে।