রাত বারোটা বাজার আগে পর্যন্ত যা ছিল অর্থ, ছিল অহংকার, সিকিউরিটি – বারোটা বাজলেই তা হয়ে গেল এক টুকরো কাগজ – গণতন্ত্রের ম্যাজিক? নাকি আলাদিনের আশ্চর্য কোন এক জাদুমন্ত্র – যেখানে একটি ঘোষণায় কাড়ি কাড়ি অর্থকে করে দেয় শুধু কাগজ!
ছিল রুমাল হয় গেল বেড়াল, নাকি ছিল বেড়াল হয়ে গেল রুমাল – যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের অবস্থা, সাময়িক হলেও কিন্তু অথৈ জলে। সন্ধ্যেতেই যে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, ফল বিক্রেতা, পান বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা – সারাদিনের ব্যবসা সেরে, ছোট ছোট খুচরো গুলোকে বদলে বড় বড় নোট গুলো নিয়ে নিজেদের পকেটকে একটু হালকা করছিল, কিংবা যারা দিন মজুরের কাজ করে বিকেলে একটা পাঁচশো টাকার নোট পেয়ে জমিয়ে রেখে ভেবেছে গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাবে – তারা তো তখনো জানতে পারে নি, ঐ টাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাতিল হয়ে যাবে, ওদের সারাদিনের পরিশ্রমের মূল্য এক টুকরো কাগজ ছাড়া আর কিছু হবে না।
ব্যাপারটা যেন ক্লাসের একটা দুষ্টু ছেলেকে শাস্তি দিতে গিয়ে, গোটা ক্লাসকে শাস্তি দেওয়ার মতো – এতে ভালো নিতান্তই গোবেচারা ছেলে, যে কিনা প্রতিদিন পড়া শিখে আসতো – সেও শাস্তি পেয়ে গেল। এক্ষেত্রে ভালো ছেলেটিও শাস্তি পায় – কারণ তার কাছে ব্যঙ্ক একাউন্টই নেই, ভালো ছেলেটি গরীব, ছোট খাটো ব্যবসা করে, দিনে আয় করে, দিনেই ব্যয় করে দেয়। টাকার রং কালো না সাদা বুঝে উঠতে না উঠতেই খরচ হয়ে যায়।
আবার, রাতারাতি, একটা পাঁচশো টাকার বদলে চারটে একশো টাকা দেওয়ার ব্যবসা শুরু হয়ে যায় – ব্যবসা যাদের রক্তে, তখন ঐ রঙচঙে কাগজেও খুঁজে নেয় অর্থের গন্ধ। কালো টাকার উপরে টাকা বদলের এই ব্রহ্মাস্তটি ছোড়ার চেষ্টা আগেও বহুবার হয়েছে – কিন্তু, নিশাচরদের অভ্যাস বদলায় নি।
বরং তারা খুঁজে নিয়েছে অন্য রাস্তা, অন্য দেশ, অন্য পন্থা – ওরা কখনোই নিজের দেশের মধ্যে ঐ টাকার সদব্যবহার করতে পারবে না, সে ওরা জানে – তাই অন্য দেশ, যে দেশে ঐ কালো অর্থের রং সাদা করা যায়, ওদের অর্থনীতির পালে হাওয়া দেওয়া যায় – নিশাচররা তাদের দেশেই যায়। ঐ নিশাচরদের অন্য অনেক মহান দেশ জায়গা দিতে দ্বিধা করে না – যেমন, ধরা যাক দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়, নাৎসি বাহিনীরা তাদের অর্থ, কালো টাকা, ঘুষের টাকা, ইহুদীদের কাছ থেকে লুট করে নেওয়া সোনাদানা, ধনরত্ন সবই সুইজারল্যান্ডে সযত্নে রেখেছিল।
যুদ্ধ শেষে কেউ সেই অর্থ দাবী করেছিল, কেউ দাবী করতে পারে নি – এতে অন্যান্য দেশের অর্থনীতির যাই হোক না কেন – সুইস অর্থনীতি কিন্তু আরও সুসংগঠিত হয়েছিল। কিংবা আরও অনেক ছোট্ট অথচ ধনী দেশ আছে, যে ছোট্ট দেশ গুলোয় পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রক্তে ভেজা টাকা, কালো টাকা ধুয়ে শুকনো করা হয়, সাদা করা হয়। আমাদের দেশের বিরাট নিশাচররা তো ঐ সমস্ত দেশে দিব্যিই জায়গা করে নেয়, কেউই তাদের টিকিরও নাগাল পায় না। সত্যই সেলুকাস, বিচিত্র এই পৃথিবী।
তবে যাই হোক, ‘নকল টাকা হইতে সাবধান’এর জন্যে এর চেয়ে ভালো উপায় হয়তো ছিল না। যে কোন অসুখের ওষুধ তেতো লাগলেও তা সাময়িক। রোগ সেরে যাওয়াই যখন মূল কথা – একটু তেতো ওষুধ খাওয়াই যেতে পারে।