ফ্লোরেন্স শহরে এসে, এ শহরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা নদী আরনোকে একদমই এড়িয়ে চলা যায় না – নদীর ধারের বাঁধানো রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখে নিতে হয় ফ্লোরেন্স শহরটিকে, অনুভব করতে হয় ফ্লোরেন্সের গায়ে জড়িয়ে থাকা প্রাচীনতাকে, ঐতিহাসিকতাকে। অবশ্য আরনো নদীর বুকে নৌকোয় ভেসেও ফ্লোরেন্স শহরকে দেখা যায়।
আর তাইতো, এপ্রিলের শেষ বিকেলে ফ্লোরেন্সে পা রেখে হোটেলে পৌঁছে লাগেজ রেখেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিলাম। যদিও সন্ধ্যা আমাদের পিছু নিয়েছিল, সন্ধ্যার আঁধারেই আরনো নদীর বাঁধানো ধার দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আরনো নদীকে দেখেছিলাম, দেখেছিলাম নদীকে কেন্দ্র করে ফ্লোরেন্স শহরের আলো আঁধারের খেলা, শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতার আধুনিক রূপ।
অতীতের এক সময়ে, মধ্য ইতালির এই অঞ্চলের পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ছিল এই আরনো নদী। ব্যবসা বানিজ্য থেকে শুরু করে, সৈন্য সামন্তের আনাগোনা, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি নিয়ে খুবই ব্যস্ত এক নদী ছিল আরনো – এক ব্যস্ত মহাসড়কের মতোই ছিল এই নদী পথ – টাইবার নদীর পরেই ইতালির অন্যতম ব্যস্ত নদী ছিল এই আরনো – আজ অতীতের সেই ব্যস্ততা, নদীকে ঘিরে মানুষের আনাগোনা আর নেই, আছে এক শান্ত ধীর বয়ে চলা।
আরনো নদী, উৎস হতে মোহনা পর্যন্ত প্রায় দু’শো চল্লিশ কিলোমিটারের উপরে পথ পাড়ি দিয়ে Marina di Pisa র কাছে এসে Tyrrhenian সমুদ্রে মিশেছে। অতীতের সেই ব্যস্ততা আজ নাই বা রইল, তবুও, তুস্কানির সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী এই আরনো আজও ইতালির তুস্কানি অঞ্চলের পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির গরমের সন্ধ্যায় এক মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দিয়ে স্বস্তি দেয় এই নদী। তবে, শান্ত, রোম্যান্টিক আরনো সবসময়ই যে এক রকমই থাকে তা নয় – ছেষট্টিতে তীব্র বন্যায় আরনো নদীর দুই কূল ভেসে গিয়েছিল – ফ্লোরেন্সের প্রচুর শিল্প কলা, ছবি, স্থাপত্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আজও নাকি ফ্লোরেন্সের কোন কোন স্থাপত্য সেই বন্যার চিহ্ন বহন করে।
এই আরনো নদীকে আবার পিসা শহরে গিয়েও সঙ্গে পেয়েছি, দেখেছি, কি ভাবে শান্ত নদীটি ঐতিহাসিক পিসার স্থাপত্য, আধুনিক জীবন যাপনকে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে। শুধু ফ্লোরেন্স ও পিসা নয়, ইতালির আরও দুই শহর Empoli ও Arezzo , কে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে আরনো।
ফ্লোরেন্স শহর কেন্দ্রে, আরনো নদীর উপরে তৈরি শতাব্দী প্রাচীন Ponte Vecchio সেতুতে দাঁড়িয়ে, যখন আরনো নদীর গভীর কালো জলের গায়ে ফুটে ওঠা ফ্লোরেন্স শহরের তিরতিরে আলোর দিকে চোখ রেখেছিলাম – এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল। ইউরোপের প্রাচীনতম এই শহর ও তার নদীর গায়ে অতি পুরনো ও নবীন এক সময় মিলে, যেন রহস্যময় এক নক্সা এঁকে চলেছে, নদীও সেই নক্সার সঙ্গী, সহযাত্রী – আর নদী ও সময়ের সেই অন্তহীন নক্সার কাটার সাক্ষী হতে পেরে অভিভূত হয়েছিলাম, সেই মুহূর্তের নক্সায় নিজেদেরকেও সামিল করে নিয়েছিলাম।