বড়পর্দায়, যে ভবঘুরের হাব ভাব, চাল চলন, কাণ্ডকারখানা দেখে মানুষ হেসে লুটিয়ে পড়ত, যার গোঁপ থেকে নিয়ে পড়নের পোশাক সবই ছিল কৌতুক রসে পরিপূর্ণ, তাঁর মুখে তো নির্বাক চলচিত্রের যুগে তো কোন ভাষা ছিল না, কথা ছিল না – তাই সে ছিল সারা বিশ্বের। কিন্তু, নির্বাক চলচিত্রের যুগ বদলে যখন টকিজ শুরু হল – সেই যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাস্যরসে পরিপূর্ণ ভবঘুরে চার্লি চ্যাপলিনকেও যে বদলাতে হবে – সে চার্লি চ্যাপলিন বুঝে গিয়েছিলেন।
কিন্তু, তাঁর মনে বিশাল এক দ্বিধা ছিল, প্রশ্ন ছিল, নির্বাক যুগের সেই মূক ভবঘুরেকে সেই সময়ের পৃথিবীর মানুষ কি ভাবে নেবে? ভবঘুরে যদি মুখ খোলে, কথা বলে – আরও পাঁচটা সাধারণ কমেডিয়ানদের মতোই হয়ে যাবে না? আবার সেই কমিক ভবঘুরের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটাও খুব দ্রুত বদলাচ্ছিল, সময় বদলাচ্ছিল – তখন সারা পৃথিবী জুড়েই সময়টা ছিল অন্যরকম।
সাদাকালো সময়, বিংশ শতাব্দীর শুরু, আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ, গ্রেট ডিপ্রেশন এই সব কিছুর মধ্য দিয়েও পৃথিবীর মানুষকে হাসিয়ে যাওয়ার কঠিন ধর্মটি পালন করে চলেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।
আর ঠিক সেই সময়ে ইউরোপে উঠে আসছিল হিটলার – চার্লি ও হিটলারের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল ছিল – দু’জনের জন্ম একই সালে, এই মাসে, একই সপ্তাহে। সেই সময়ে দু’জনেই নিজের জগতে নিজেদের ব্যক্ত্বিত্ব দিয়ে পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছিল – অন্তত হিটলার সেই সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ছিল, হিটলারের এক একটি বক্তৃতা শোণার জন্যে জমায়েত মানুষের ভিড় উপছে পড়ত।
ইউরোপ তখন হিটলার জ্বরে আক্রান্ত ছিল – সেই সময় জার্মানির অর্থনীতিকে দৃঢ় করা থেকে শুরু করে ব্যবসা বানিজ্যের উন্নতি – সবই ছিল হিটলারের কৃতিত্ব। সমগ্র ইউরোপ আমেরিকা সবাই জার্মানির সঙ্গে ব্যবসা করতে চায় – কিন্তু, জার্মানিতে ইহুদীদের প্রতি হিটলারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকা যেন আশ্চর্য ভাবে উদাসীন ছিল। কোন দেশই তখন হিটলারকে চটাতে চাইতো না।
এমনি এক সময়ে ভবঘুরে চার্লি যখন ভাবলেন, জার্মানির যে লোকটি তাঁর গোঁপ চুরি করে, ইহুদীদের উপরে অত্যাচার করে, একনায়ক হয়েছে, যে লোকটি মানবতাকে, গণতন্ত্রকে একঘরে করেছে, কোণঠাসা করেছে, যে লোকটি মানুষের বাক্-স্বাধীনতার গলা টিপে ধরেছে – তার বিরুদ্ধেই বরং মুখ খোলা যাক – ‘The Great Dictator’ হিসাবে – নানা মহল থেকে প্রচুর আপত্তি এসেছিল।
এমনকি, নাৎসিদের তরফ থেকে প্রচুর হুমকিও এসেছিল। চার্লিকে ইহুদি প্রমানের জন্যে, চার্লি চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে নানান নাৎসি প্রোপ্যাগান্ডা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি, হলিউডের বিভিন্ন মহল, চার্লিকে এই সিনেমাটি বন্ধ করে দেওয়ার উপদেশ দিয়েছিল – কারন বার্লিনে হলিউডের সিনেমার এক বড় অংশের দর্শক ছিল। তাছাড়া, ব্রিটেনেও চার্লির ‘The Great Dictator’ মুক্তি না পাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। আসল কথা, হিটলারকে, নাৎসি জার্মানিকে তখন কেউই চটাতে চায় নি।
কিন্তু, চার্লি চ্যাপলিন হলিউডের এমন এক অভিনেতা ছিলেন – যার নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস ছিল, তাই চার্লি চ্যাপলিন নানা মহলের নানান আপত্তি সত্ত্বেও এই সিনেমার কাজ চালিয়ে যান। চার্লি চ্যাপলিন যে সময়ে, ‘The Great Dictator’ তৈরির কথা ভাবছিলেন ও শুটিং শুরু করেছিলেন, এমনকি সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল যে সময়ে, তখনো আমেরিকা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে নি।
এই সিনেমার শুটিং ও মুক্তির সময়ের ব্যবধান ছিল দুই বছর – আর এই দুই বছরে ইউরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রচুর বদলে গিয়েছিল, আর হলিউডও তখন চার্লির ‘The Great Dictator’ এর জন্যে অধীর অপেক্ষায় ছিল। মুক্তি পাওয়া মাত্র আমেরিকায় প্রচুর জনপ্রিয়তা পেল চার্লির ‘The Great Dictator’। আমেরিকার মানুষ সিনেমাটিকে চার্লি চ্যাপলিনের অন্যতম মাস্টারপিস আখ্যা দিল। তখন আমেরিকার অনেকের কাছে মনে হয়েছিল চার্লির ‘The Great Dictator’ হয়তো আমেরিকার কাছে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্যে এক আবেদন ছিল।
ব্রিটেনেও যথারীতি ‘The Great Dictator’ মুক্তি পেল – চার্লি চ্যাপলিনের আশংকা ছিল – যুদ্ধের সংবেদনশীল সময়ে একনায়ককে নিয়ে কমেডি করাটা হয়তো মানুষ পছন্দ নাও করতে পারে। কারণ, এই সিনেমায় চিরন্তন সেই ভবঘুরে কমিক চার্লি ছিল না – ছিল টমানিয়ার একনায়ক হিঙ্কল। অবশ্য অন্যান্য অনেক দেশ যারা নাৎসিকে সাপোর্ট করতো সেই সব দেশে চার্লির ‘The Great Dictator’ মুক্তি পায় নি, এমনকি নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সকে চার্লির ‘The Great Dictator’ দেখার জন্যে যুদ্ধ শেষের অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
যুদ্ধের সেই সংবেদনশীল সময়ে এমন এক ভবিষ্যৎ দর্শী সিনেমা তৈরি করার মতো সাহস ও দূরদর্শিতা খুব কম অভিনেতার মধ্যে দেখা যায়, আর তাই তো চার্লি চ্যাপলিন শুধু এক কমেডি অভিনেতা নন – সুদূরদর্শী মহান এক ব্যক্ত্বিত্ব। ‘The Great Dictator’ এর শেষের বক্তৃতাটি আজকের যুগেও যেন সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক।