ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরের গলির গলি, তস্য গলি, যে কোন বিদেশী মানুষের কাছে গোলক ধাঁধাঁ ছাড়া আর কিছু নয় – আর সেই গলি ধরে হেঁটে যেতে যেতে শহরটিকে দেখতে দেখতে, পথ হারিয়ে ফেলাও আশ্চর্যের কিছু না।
আর, যেহেতু, ইউরোপের শহর গুলোর বেশীর ভাগ সময় রাস্তাঘাট জনমানবহীন নির্জন, তারপর নানা জায়গায় ভাষা বোঝারও অসুবিধে, তাই, কাউকে রাস্তা জিজ্ঞেস করে নেওয়ার আমাদের সেই পুরনো অভ্যাসটিকেও জলাঞ্জলি দিতে হয়। তখন, আমাদের মতো বিদেশীদের কাছে একমাত্র অস্ত্র হল – প্রাচীন কালের নাবিকদের মতো – চিরাচরিত ঐতিহ্যময় সেই ম্যাপ।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই ভ্রমণ কারীদের পথ দেখিয়ে এসেছে – ম্যাপ। আঠারো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে সামরিক বাহিনীর জন্যে ম্যাপ তৈরি হয়েছিল, তাছাড়া, নেপোলিয়ানের আক্রমণের ভয়েও ইংরেজরা তাদের জায়গাকে ভালো ভাবে জানার জন্যে, রণনীতি তৈরি করার জন্যে ম্যাপকে আরও আরও উন্নত করার কাজ করেছিল। তারপর, নেপোলিয়ানের ভয় ও তার যুগ শেষ হওয়ার পর, শুরু হল – আবিষ্কারের যুগ, মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে শুরু করল, ভ্রমণ শুরু করল – তখন যে কোন জায়গাকে, দেশকে ভালো করে জানাটা, বোঝাটা আরও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।
তাই, তুলুসে এসে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, প্রথমেই যে জিনিসটি কিনেছিলাম – তুলুসের একটি বিস্তারিত ম্যাপ। নতুন এক দেশে এসে, যেখানে কিছুই জানা থাকে না – মনে হয়, ম্যাপের মতো বন্ধু আর কেউ হয় না। কিন্তু, শুধু ম্যাপ কিনলেই তো হয় না, ম্যাপ দেখাটাও রপ্ত করে নিতে আমাদের বেশ সময় লেগেছিল।
তুলুসে এসে দেখেছিলাম, এরা ম্যাপ দেখাটাকে বেশ ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করে নিতে পারে। তুলুসের রাস্তায় প্রায়ই দেখি, এক দল স্কুলের বাচ্চা কল কল করতে করতে শহর কেন্দ্রে ঘোরাঘুরি করছে – প্রত্যেকের হাতে তুলুসের ম্যাপ। সঙ্গে ওদের শিক্ষক – তিনি দেখিয়ে দেন, কি ভাবে ম্যাপ ধরতে হয়, ম্যাপ দেখা শিখতে হয়, রাস্তা চিনে নিতে হয়।
টেক গুরুরা হয়তো বলবে – আজকের দিনে কি দরকার ম্যাপ দেখা শেখার? ছাপা ম্যাপ নিয়ে ঘোরাঘুরির দিন শেষ। এখন স্মার্ট ফোন আছে, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম আছে, গুগুল ন্যাভিগেশন আছে, এপ আছে, আছে আই ফোন – ছাপানো ম্যাপ কিছুদিনের মধ্যেই বাতিলের দলে চলে যাবে, মিউজিয়ামে স্থান পাবে।
চলবে