ইউরোপের পথে চলতে চলতে, গলির মোড়ে বা রাস্তার পাশে প্রায়ই নানা ধরণের ব্রোঞ্জ স্ট্যাচু নজরে পড়ে – ইউরোপের অন্যান্য বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক ও বড় স্ট্যাচুর কাছে সেই সব স্ট্যাচুকে অতি ছোট বলে মনে হলেও যেন ঐ ধরণের ছোট স্ট্যাচু সেই জায়গাকে মনে করিয়ে দেয়, সেই জায়গার এক একমেবাদ্বতীয়ম চরিত্রটি প্রকাশ করে – হোক না যতই ছোট, পৃথিবীর ঐখানেই ঐ স্ট্যাচু আছে।
না, বড় কোন রাষ্ট্র নায়ক বা যুদ্ধ জয়ী বীরের স্ট্যাচু নয়, হয়তো সাধারণ মানুষেরই ছোট্ট স্ট্যাচু, কিন্তু, ইউরোপের পথে সেই ভাস্কর্য এক সৌন্দর্য যোগ করে, ইউরোপের মানুষের শিল্পের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে।
যেমন, পোর্তো শহরের পথে চলতে চলতে রাস্তার মোড়ে ডাকবাক্সের পাশে দাঁড়ানো পোস্টম্যানের স্ট্যাচুটিকে দেখে তো জীবন্ত মানুষ বলেই মনে হয়েছিল – কারণ, ইউরোপের নানা জায়গায় জীবন্ত স্ট্যাচু সেজে, রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর খুবই চল আছে – অবশ্য সামনে টুপি রাখা থাকে, পথচারীরা টুপিতে এক, দুই ইউরো দিয়ে যায়।
ফিনল্যান্ডে তো এক জীবন্ত স্ট্যাচুকে চোখের সামনেই পুলিশের ভয়ে পালাতে দেখেছি। আবার বার্সিলোনায় তো এক স্ট্যাচুকে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিকে নজর রাখতে দেখেছি। আবার, জাপানিস টুরিস্ট যখন স্ট্যাচুর পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে, একটু পরেই স্ট্যাচুটি নড়ে উঠলে চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
আবার, শহরের মাঝে কখনো কখনো একদল স্ট্যাচু সেই শহরের ল্যান্ডমার্ক হয়ে যায়। হেলসিঙ্কি শহরের মাঝে Three Smiths Statue বা সুইডেনের গথেনবার্গ শহরের ফিশ চার্চের সামনে একদল মৎস্যবিক্রেতা ও তার কুকুরের স্ট্যাচু সেই জায়গাতে যেন আরও বৈশিষ্ট যোগ করে দেয়, যেমন, গথেনবার্গ শহরের মাঝে গ্রীক সমুদ্রদেবতা Poseidon, যার এক হাতে মাছ ও আরেক হাতে সমুদ্র ঝিনুক নিয়ে দাঁড়ানো স্ট্যাচুর ছবি একনজর দেখেই বলে দেওয়া যায় – আরে এতো গথেনবার্গ শহর।
আবার, লাটভিয়ার রাজধানী রিগার পার্কে চলার পথে সকালের প্রথম সোনালি আলো একদল স্ট্যাচুকে যখন স্নান করিয়ে দিচ্ছিল আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল – হয়তো স্ট্যাচুটি রিগার বড় কোন মানুষ, সঙ্গে তার স্ত্রী, ও কুকুরটি। পার্কের সবুজ ও ফুলের বিছানার পাশে স্ট্যাচুগুলোকে দিব্যি মানিয়েছে।
কিংবা, প্রাগ ক্যাসলে যাওয়ার সিঁড়ির পথের স্ট্যাচু যেমন নজর কেড়েছে, তেমনি সেই স্ট্যাচুর ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়ানো এক বয়স্ক মানুষের সুরেলা গিটার বাজানোও মন টেনেছে – হয়তো, সেই বৃদ্ধ মানুষটি সেখানে দাঁড়িয়ে আজও গিটার বাজায়, তার সুর আজও মুগ্ধ করে।
কোথাও কোথাও যে আবার স্ট্যাচুর চোখ দিয়েও শহরের সৌন্দর্য ধরা পড়ে – তা জানা ছিল না। যেমন, বুদাপেস্টের পার্লামেন্ট হাউসের ঠিক উল্টো দিকে ছোট্ট ব্রিজের উপরের দীর্ঘ স্ট্যাচুটির পাশে দাঁড়িয়েই যে বুদাপেস্টের পার্লামেন্ট হাউসের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ধরা পড়ে, তা তো আমাদের এক্কেবারেই জানা ছিল না, কিন্তু, সেই দীর্ঘ ব্রোঞ্জ স্ট্যাচুর পাশে দাঁড়িয়েই দেখি পার্লামেন্ট হাউসের সম্পূর্ণ দৃশ্য আমাদের চোখে ধরা দিল।
ইউরোপের পথে কতো ধরণেরই না স্ট্যাচুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কতো ছবিই না তৈরি হয়েছে, কে তার শিল্পী, স্ট্যাচুর মানুষটি কে, হয়তো ইউরোপের ইতিহাসের কোন নামী মানুষও হতে পারে – তা যেন জানারও ঠিক প্রয়োজন বলে মনে হয় নি, শুধু স্ট্যাচু গুলোর নাটকীয় উপস্থিতিই আমাদের নজর কেড়ে নিয়েছে, দু’ দন্ড থামিয়েছে, শুধু দেখার আনন্দেই দেখেছি, ছুঁয়েছি – শুধু কি স্ট্যাচু? সেই স্ট্যাচুকে ঘিরে সেই জায়গার মানুষের আবেগকেও দেখেছি, দেখেছি জীবনযাপন।