প্যারিসের সবচেয়ে বড় পাবলিক স্কোয়ার – Place de la Concorde । তুলারিস গার্ডেনের একদম সামনেই অষ্টভুজ আকারের এই বিশাল পাবলিক স্কোয়ারের পাশ দিয়ে প্রতিদিন হাজার প্যারিসবাসী আসা যাওয়া করে, প্রচুর টুরিস্ট এখানে এসে, বসে বা দাঁড়িয়ে প্যরিসের ব্যস্ততার দিকে চোখ রাখতে পারে, এখানে এলে প্যারিসের ছন্দময় ব্যস্ত রূপ ধরা দেয় – অথচ ফরাসী বিপ্লবের সময়ে এই স্কোয়ারের মধ্যে গিলোটিন স্থাপন করা হয়েছিল।
ফরাসী রাজা লুই পনেরোর সময়ে এই স্কোয়ার তৈরি হয়ে, তার নামেই এই স্কোয়ারের নাম ছিল – Place Louis XV, তখন লুই পনেরোর এক মূর্তিও এই স্কোয়ারে শোভা পেত। ফরাসী বিপ্লবের উত্তাল সময়ে রাজা লুইয়ের মূর্তি ভেঙ্গে এই স্কোয়ারের নাম হয়ে যায় – Place de la Révolution, ও এখানে গিলোটিন স্থাপন করে, একে একে ফরাসী রাজপরিবারের সমস্ত সদস্যদের গিলোটিনে শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল।
আঠারো শতাব্দীতে, ফরাসী বিপ্লবের সময়, ফ্রান্সের সেই উত্তাল, অশান্ত, গণ আন্দোলনের সময়ে মাত্র দু’বছরের মধ্যে, হাজার হাজার উন্মত্ত, অশান্ত ফরাসী জনতার হর্ষধ্বনির সামনে এই স্কোয়ারের গিলোটিনে একে একে রাজা লুই ষোল, রানী মারী আন্তনিতে থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার আটশো মানুষের শিরচ্ছেদ করা হয়েছিল। ফরাসী ইতিহাসের পাতা রাজ রক্তে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল, ফরাসী বিপ্লবের রং ছিল রক্ত লাল – আর তার সাক্ষী এই স্কোয়ার।
সেই সময়ে এই স্কোয়ার চত্বর রাজ রক্তের স্রোতে লাল হয়ে উঠেছিল। তখন এই স্কোয়ার সর্বদা পুরু রক্তের চাদরে ঢাকা থাকতো, রক্তের গন্ধে মানুষ তো বটেই এমনকি গবাদি পশুরাও এই পথে যেতে চাইতো না।
সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত অশান্তি শান্ত হয় – ফ্রান্সেও বিপ্লবের পরে ফিরে এলো শান্তি, আর এই স্কোয়ারের নাম বদলে হল ‘Place de la Concorde ’, অবশ্য মাঝে দু’বার রাজা লুই পনেরো ও ষোলর নামে এই স্কোয়ারের নামকরণ হয়েছিল কিন্তু পরে এই স্কোয়ারের নাম Place de la Concorde ই রয়ে গেল।
সময় কখনো থামে না, আজ এই স্কোয়ারে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক সত্য। আজকের Place de la Concorde প্যারিসের এক আলোকিত, আনন্দময় এক স্কোয়ার – স্থানীয় মানুষ, টুরিস্টের নিশ্চিন্ত সময় কাটানোর এক ঠিকানা। এখন এই স্কোয়ারের প্রধান আকর্ষণ ইজিপ্টের এক থাম ‘Obelisk of Luxor’।
উনিশ শতাব্দীতে মিশরের ভাইসরয় ফ্রান্সকে এই অবেলিক্স উপহার দিয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিনহাজার বছর পুরনো, আকাশচুম্বী এই অবেলিক্সের গায়ে গায়ে হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি আঁকা, আর আকাশচুম্বী চূড়াটির উপরে সোনার পিরামিড আকারের এক টুপি ঝকঝক করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এই অবেলিক্স যেন এই স্কোয়ারের এক অলংকার। অষ্টভুজ আকারের এই স্কোয়ারের আট কোণের আটটি মূর্তি ফ্রান্সের আটটি বড় শহরের প্রতীক। আর, স্কোয়ারের একদম মাঝে কাল্পনিক উপবৃত্তের দুই কেন্দ্রে দুই অপূর্ব ফোয়ারা সাগর ও নদীর প্রতীক।
প্যারিসে এলে এই স্কোয়ারে একবার তো আসতেই হয়, শীতের সন্ধ্যায় তুলারিস গার্ডেনে যদিও মানুষের আনাগোনা কমে গেছে, কিন্তু এই Place de la Concorde বেশ জমজমাট। ভেজা বাতাসে ভেসে আসছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের গন্ধ, বিশাল নাগরদোলায় চড়ে বসা মানুষের উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত চিৎকার ভেসে আসে – সব মিলিয়ে বহমান জীবনের সহজ সরল দাবী গুলো এতোই বাস্তব হয়ে ওঠে যে ফরাসী বিপ্লবের সমস্ত রক্তাক্ত ইতিহাস তোলা থাক এক তালা বন্ধ বাক্সে, আর তার চাবিটি যাক হারিয়ে।