“এই যে লাস্ট বেঞ্চ! উঠে দাঁড়াও। বল পানিপথের যুদ্ধ কবে হয়েছিল?”
যার দিকে রতন স্যার ইশারা করছেন সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে – পিন্টু।
পিন্টু, কাঁচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়ালো। মুখ নিচু করে একবার সারাটা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিল। দেখে নিল সবার প্রতিক্রিয়া, বা কেউ যদি স্যারের চোখ এড়িয়ে উত্তরটা বলে দেয়। কিন্তু, না। নিস্তব্ধ সারাটা ক্লাস। কারুর সাহস নেই পিন্টুকে এক রতি সাহায্য করার। অন্য স্যার হলে ওরা হয়তো চেষ্টা করতে পারতো, কিন্তু রতন স্যারের ক্লাসে এমনটি করার সাহস কারুর নেই।
রতন স্যার প্রচণ্ড ভাবে কড়া ধাতের মানুষ। প্রায় ছ’ফিট মত উচ্চতা, যেমন উচ্চতা তেমনি গলার স্বর। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পড়েন, ঠোঁটের উপরে মোটা গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া কালো কুচকুচে চুল। ওনার বয়স প্রায় চল্লিশ। হাতে সর্বদাই লিকলিকে বেত থাকে। এক কথায় সারাটা স্কুল রতনবাবুর ভয়ে কাঁপে। উনি আবার খেলারও শিক্ষক। আগে নাকি খুব খেলা ধূলা করেছেন। তার তত্ত্বাবধানে ছেলেদের নিয়ম শৃঙ্খলার একটু এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। খেলার মাঠে খেলোয়াড়ি নিয়মানুবর্তিতা বিশ্বাস করেন।
শিক্ষকরা বলাবলি করেন, যে রতনবাবুর মত কড়া শিক্ষক ছেলেদের এই স্কুলে আছেন বলেই এই স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় আছে। নাহলে, দুষ্টু, বাঁদর, দামাল ছেলেদের কিছুতেই সামাল দেওয়া যেত না। ছাত্র মহলে রতনবাবুকে নিয়ে অনেক আতঙ্কের গুজব ছড়ানো আছে। এই স্কুলের ছাত্ররা বাঘ বা পুলিশ কাউকেই হয়তো ভয় পায় না, কিন্তু রতনবাবু ছুঁলে যে কি হবে সেই ভয়েই অনেক বেয়াড়া ছাত্র শিউড়ে ওঠে।
এদিকে আবার পিন্টুও দারুন দুষ্টু বলেই শিক্ষক ও ছাত্র মহলে পরিচিত। স্কুলের যাবতীয় দুষ্টুমিতে পিন্টুর নামই আগে আসে। সে ক্লাস চলাকালীন স্কুলের বাথরুমে পটকা ফাটানোই হোক, বা লেজে মোচড় দিয়ে খেলার মাঠের বাচ্চাদের দিকে ষাড় লেলিয়ে দেওয়াই হয় – পিন্টুর নামই সবাই প্রস্তাব করে। তাছাড়া, পড়াশোনা ছাড়া স্কুলের বাকি সব কাজেই পিন্টুকে পাওয়া যায়, সেখানে পিন্টুর উৎসাহের সীমা থাকে না। স্কুলের স্বরস্বতী পুজো থেকে শুরু করে স্পোর্ট ডে, এন্যুয়াল ডে, পিকনিক সব কিছুতেই পিন্টুর জুড়ি মেলা ভার। মোটকথা, পড়াশোনা ছাড়া বাকি সব কাজেই পিন্টুকে পাওয়া যায়।
সেই পিন্টুকে আজ রতন স্যার পড়া ধরেছেন। পিন্টুর মাথায় যেন বাজ পড়ল। পিন্টু ভাবে পানিপথের যুদ্ধের কথা জেনে আর কি হবে? উত্তর দিতে না পারলে তো এখুনি বেত্র যুদ্ধ শুরু হবে। পিন্টু কিছুক্ষণ ক্লাসের এদিক ওদিক থেকে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু, না। কোথাও থেকে কোন সাহায্য পাওয়া গেল না। তাই অগত্যা পিন্টু পানিপথের যুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্পণ করাই শ্রেয় বলে মনে করল। মাথা নিচু করে উত্তর দিল – জানি না স্যার।
ব্যাস, শুধু জানি না শোণার অপেক্ষাতেই ছিলেন রতনবাবু। শোণা মাত্রই চিরবিরিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। হুঙ্কার দিলেন – কি? এই সামান্য উত্তরটুকু জানো না? এসো এদিকে।
ওনার হাতের লিকলিকে বেতটা যেন সাপের মত ফণা তুলে হিলহিলিয়ে উঠল, বাতাস কাটার শব্দ শোণা গেল হিস হিস, রাগি সাপ যেন ফণা তুলে ছোবল কাটার অপেক্ষায়। শান্ত ক্লাসে ছাত্ররা আতঙ্কে সিটিয়ে গেল।
পিন্টুর আবার এই সবে অভ্যাস আছে, সে নির্ভয়ে পরাজিত রাজার মত এগিয়ে গেল। জানে হাতের তালুতে কয়েকটা শপাং শপাং করে বেতের ঘা পড়বে। একটু জ্বালা করবে কিছুক্ষণ, পরে ঠিক হয়ে যাবে। পিন্টুর কাছে পড়া মুখস্থ করার চেয়ে বেতের ঘা খাওয়া বেশ সোজা বলে মনে হয়।
যাইহোক, পিন্টু রতন স্যারের বেতের ঘা মুখ বুজে সহ্য করে নিল। ক্লাসের অন্য ছেলেরা শিউড়ে ওঠে এহেন বেত্রাঘাতে। ওরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় – এবার থেকে মন দিয়ে পড়বে, কখনো যেন পিন্টুর মতো শাস্তি পেতে না হয়। তার জন্যে যত পরিশ্রম করা দরকার ওরা করবে।
দেখতে দেখতে গরমের ছুটি চলে এলো, গরমের ছুটির দারুন মজার শেষে সবাই নতুন উদ্দমে ক্লাসে ফিরে এলো। নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা সবার মনে। শিক্ষকেরা নতুন উদ্যমে পড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
ভালো ছাত্ররা পড়াশোণায় মন দিল, বখাটেরা বাঁদরামিতে মন দিল আর পিন্টু দিল দুষ্টুমিতে মন। এরই মধ্যে একদিন বিমল খবর নিয়ে এলো, যে রতন স্যারের মাথার ঝাঁকড়া কুচকুচে কালো চুল নাকি আসল নয় – ওটা নকল, পরচুলা। প্রথমে তো ক্লাসের কেউই বিশ্বাস করে নি। সবাই বিমলের কথায় বিন্দুমাত্র কান দিল না, পাত্তা দিল না, সবাই হেসে উড়িয়ে দিল। সবাই জিজ্ঞেস করল – তুই এটা কি করে জানলি?
‘আরে, স্যারের বাবা মারা গিয়েছিলেন গরমের ছুটিতে, স্কুল খোলার ঠিক কিছুদিন আগে। তখন আমি স্যারকে ঔষধের দোকানে দেখেছিলাম। মাথায় একটাও চুল নেই, চক চক করছে টাক। এই ক’দিনের মধ্যে মাথায় এতো সুন্দর ঝাঁকড়া, কালো কুচকুচে চুল গজাল কি করে? মামদোবাজি নাকি? ওনার বাবা যখন মারা যান, উনি শুধু কিছুদিন পরচুলাটা পড়েন নি। এই আর কি! আমি ভেবেছিলাম, স্কুলে এসে দেখবো স্যারের মাথায় অল্প অল্প চুল গজিয়েছে মানে ন্যাড়ার পরের দশা আর কি! কিন্তু, না! মাথায় দেখি ঝাঁকড়া চুল তাই আমার সন্দেহ হল, আর তোদের বললাম।’ – বিমল এমন মুখ করে উত্তর দিল যেন শার্লক হোমস গোয়েন্দাগিরিটা ওর কাছেই শিখেছে কিংবা নিজেকে ব্যোমকেশ বক্সীর সমগোত্রীয় ভাবছে।
পরচুলার কথাটা কেউ বিশ্বাস না করলেও অবিশ্বাসনীয় কথাটা প্রথমে পুরো ক্লাসে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগলো না। পিন্টুর কাছেও সেই কথা পৌঁছে গেল। পিন্টু জিজ্ঞেস করল – তুই প্রমান করতে পারবি?
বিমল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল – না। কিন্তু, এতে প্রমান করার কি আছে? আমি দেখেছি। সত্যি দেখেছি।
অন্য ছেলেরা যারা বিমলের কথা শুনছিল, সবার চোখ পিন্টুর দিকে ফিরে গেল, একজন বলল – তুই প্রমান করতে পারবি?
পিন্টু যেন এই প্রশ্ন শোণার অপেক্ষাতেই ছিল, বলল – হ্যাঁ পারবো, বল যদি প্রমান করি কত দিবি? চ্যালেঞ্জ?
ছেলেরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে উত্তর দিল – নে সবাই আমরা দশ দশ টাকা করে দেবো। যদি তুই প্রমান করতে পারিস, স্যারের চুল পরচুলা।
বিমল অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল – তুই পুরো স্কুলের সামনে প্রমান করতে পারবি? কি করে করবি?
পিন্টু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল – হ্যাঁ রে পারবো। সেটা আমার ব্যাপার, আমি করবো। কি ভাবে করবো সেটা আগে থেকে বলা যাবে না। তবে টাকা রেডি রাখিস, প্রমান আমি করবোই।
পিন্টুর চোখে মুখে এক দুষ্টু হাসির ঝলক খেলে গেল। টিফিন হতেই পুরো স্কুলে মোটামুটি খবরটা চাউর হয়ে গেল যে রতনস্যারের চুল আসল নয়, পরচুলা। আর পিন্টু সেটা সবার সামনে প্রমান করবে, চ্যালেঞ্জ নিয়েছে।
পিন্টুরা পড়ে ক্লাস নাইনে। ছোটদের কানে খবরটা যাওয়া মাত্র পিন্টুর ভবিষ্যৎ ভেবে ছোটরা শিউড়ে উঠল। যেদিন পিন্টু সবার সামনে প্রমান করবে রতন স্যারের চুল আসলে পরচুলা, সেদিন পিন্টুর কি দশা হবে? শরীরের কটা হাড় আস্ত থাকবে সেটা নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গেছে।
যাইহোক, পিন্টু রতন স্যারের চুল ‘পরচুলা’ প্রমান করার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পরে অনেক দিন কেটে গেল। স্কুলের নানান নিত্য নতুন ঘটনার ভিড়ে ছোট ক্লাসের ছেলেরা ভুলতেই বসেছে চ্যালেঞ্জের ব্যপারটা। এমনকি পিন্টুর ক্লাসেও রতন স্যারের প্রতিপত্তির ফলে চ্যালেঞ্জের কথাটা চাপাই পড়ে গেছে বলা যায়। সবার মন থেকে ধুয়েই গেছে রতন স্যারের পরচুলার কথাটা।
শুধু বিমল মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করে পিন্টুকে – কি রে তুই ভুলে গেলি? তুই বোধহয় আর প্রমান করতে পারবি না। কেন যে চ্যালেঞ্জ নিতে গেলি?
বিমলের কথা শুনে পিন্টু মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে মুচকি হাসে, যেন মনে মনে দৃঢ় এক দুষ্টু ফন্দি আঁটছে।
শনি রবিবারের ছুটির পর, সোমবারে সবাই এসেছে স্কুলে। স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনা চলছে, সবাই এক মনে প্রার্থনা শেষ করছে। সব স্যারেরা সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রার্থনা শেষ করার পর সবাই যে যার ক্লাসে যাবার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছে। হঠাৎ পিন্টু সাঁ করে ক্লাস নাইনের লাইন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে রতন স্যারের দিকে দৌড় দিল। স্যারের মাথার চুলের উদ্দ্যেশ্যে হাত বাড়াল, চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে, চিলের মত ছোঁ দিয়ে পরচুলা খুলে নিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। পালালো মানে – একদম স্কুলের গেটের বাইরে।
সমস্ত স্কুল হতবাক, স্যারদের চোখ ছানা বড়া। কিছুক্ষণের জন্যে নিঃশব্দ, যেন ঝড়ের পূর্ব মুহূর্ত, পরক্ষণেই পিন্টুর ক্লাসের ছেলেরা প্রথমে, পরে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। কিছু ছেলেরা তো হাসতে হাসতে পেট চেপে বসে গেল। রতন স্যারের মুখ দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা, হতবাক, রেগে আগুন। স্যারের চকচকে টাক দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য স্যারেরা মুখ চেপে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন। রতন স্যার প্রচণ্ড থমথমে হয়ে গেছেন।
এদিকে পিন্টু স্কুল থেকে বেরিয়ে দৌড়ে চলেছে। দৌড় দৌড় আর দৌড়, পিন্টু আর কয়েকদিন স্কুল মুখো হচ্ছে না।