August 2013, Dubrovnik, Croatia
সদ্য সন্ধ্যার ঘন নীল অন্ধকারে অ্যাড্রিয়াটিক (Adriatic) সমুদ্রের উপর দিয়ে যখন আমাদের প্লেন নামার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, জানালা দিয়ে নীচে নীল অন্ধকারে জঙ্গল, পাহাড় শ্রেণী ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ে নি।
ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেন যখন ক্রোয়েশিয়ার দুব্রভনিকের (Dubrovnik) মাটি ছুঁল, মনে হল যেন সমুদ্রের মধ্যেই প্লেন ল্যান্ড করল। সূর্যের শেষ আলো তখনও পশ্চিম আকাশ মৃদু রাঙিয়ে রেখেছে। শহর থেকে অনেক দূরে এয়ারপোর্টের চারিদিকে অন্ধকার পাহাড় শ্রেণীর মাঝে মনে হল এ কোন অচিন দেশে এলাম রে বাবা। ছোট এয়ারপোর্টটিকে অন্ধকারে কেমন নিঝুম নির্জন একাকী মনে হল।
কিছুদিন আগেই এই দেশের বাতাসে বারুদের গন্ধ ভাসতো, যুদ্ধের মাইন পাতা ছিল এই দেশের জমিতে। সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে এই দেশের অনেক নাগরিক প্রান হারিয়েছিল। এখানে আসার আগে মনে দ্বিধা ছিল, যুদ্ধের ক্ষত কি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রতীরের এই দেশটি?
কিছুদিন আগেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশটি, কিন্তু এখনো এই দেশের মুদ্রা ক্রয়েশিয়ান কুনা। তাই কিছু ইউরো কুনায় বদলে নিয়ে এয়ারপোর্টের ঠিক বাইরেই শহরে যাওয়ার বাস স্টপে পৌঁছে গেলাম। সুন্দর ঝা চকচকে এসি বাস মৃদু গান বাজিয়ে মসৃণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল শহরের দিকে। রাস্তায় চলার একফোঁটা ঝাঁকুনি নেই বাসের, মনে হল যেন এরোপ্লেনেই বসে আছি।
নাঃ, আজ এই দেশের কাছে যুদ্ধ এক অতীত স্মৃতি। এই দেশের বহু রাস্তাঘাট যুদ্ধের বোমা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু এখন ক্রয়েশিয়ান সরকার দেশটির রাস্তাঘাট তৈরির পেছনে বহু অর্থ খরচ করেছে। অতীতের এই যুদ্ধ পীড়িত দেশটি এখন ইউরোপের অন্যতম টুরিস্ট গন্ত্যব্য। এখন যেন এখানে টুরিস্টের ঢল নেমেছে, এমনকি এই দেশের অর্থনীতির এক বড় অংশ ট্যুরিজম নির্ভর।
দু’পাশে ঘন অন্ধকার জঙ্গল পাহাড়ের মাঝে গাড়ি মসৃণ গতিতে ছুটে চলেছে। যুদ্ধের ক্ষত ভুলে কি করে সাজিয়ে তুলতে হয় নিজের দেশকে ক্রোয়েশিয়া তার এক বড় উদাহরণ। এখন এই দেশের অনেক বেশী HDI।
দূর থেকে দেখা গেল অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রতীরের দুব্রভনিকের আলো। পাহাড়ের বুকে আলোর মালায় সাজানো শহরটি রাতের অন্ধকারে ঝলমল করছে। দুব্রভনিক শহরটি মধ্য যুগের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, আলোর মালায় সেজেছে সেই সিটি ওয়াল। মধ্য যুগের এই সিটি ওয়াল শুধু যে অতীতের যুদ্ধ বিগ্রহের আক্রমণ থেকে এই শহরকে বাঁচিয়েছিল তা নয়, সাম্প্রতিক যুদ্ধেও এই সিটি ওয়াল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বোমার আঘাতে এই সিটি ওয়ালের অনেক অংশ ও পুরনো দুব্রভনিক শহরের অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখানের অনেক বাড়ীর ছাদ উড়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন সমস্ত অতীত।
বাস যখন শহরের মাঝ দিয়ে সিটি ওয়ালের পাশ দিয়ে পার হচ্ছিল, দেখলাম সিটি ওয়ালের পাশে প্রচুর টুরিস্ট ঘোরা ফেরা করছে। মধ্যযুগের শহরটিতে রাতের আলো আঁধারের মাঝে প্রাণবন্ত হাসিখুশি মানুষের ও শহরের ঝলক দেখে সংক্রামিত হাসি-আনন্দ যেন আমাদেরও ছুঁয়ে গেল। ভালো লাগল।
বন্দর ও বাসস্টপ এখানে পাশাপাশি। আমাদের হোটেল Gruz বন্দর ও বাসস্টপের ঠিক উল্টো দিকে, পাহাড়ের উপরে। সিঁড়ি বেয়ে হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল। এখানে হোটেল ঠিক হোটেল নয়, অনেকটা বাড়ীর মত। স্থানীয় মানুষেরাই নিজেদের বাড়ীর কিছু ঘর ভাড়া দেয় হোটেলের মত। গৃহকর্তা খুবই আপ্যায়ন করে এখানে।
পাহাড়ের উপরে বাড়ী-হোটেলের ব্যালকনি থেকে রাতের নির্জন দুভ্রভনিকের ছবি চোখ জুড়িয়ে দেয়। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে দেয় সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া। অনেকক্ষণ বসে নির্জনতা অনুভব করতে করতে কালকের শহর বেড়ানোর প্ল্যান করে নিলাম।