আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো, প্রিয় দে…শ… – নির্বাসিত ছবির টেলারের এই কথাটা যেন হৃদয় ছুঁয়ে গেল, হৃদয় মুচড়ে দিল, এক হালকা ব্যথা যেন জেগে উঠল। এবং জানি, যারা বহুদিন দেশ ছাড়া তাদেরকেও এই কথাটা ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।
নির্বাসিত ছবিটি রিলিজ হতে চলেছে। টেলার দেখে একটা ছবিকে কতটুকুই বা জানা যায়, বোঝা যায়, ছবিটা নিয়ে ভাবা যায়, লেখা যায়? কিন্তু, যখন টেলারই চেতনাকে নাড়া দিয়ে যায়, ভাবায় – তখন লিখতে ইচ্ছে করে বৈ কি।
কখনো কোন দেশ কোন বিশেষ এক মানুষকে চায় না, কেন চায় না, কে চায় না তাকে, সে মানুষটি নিজেও তা জানে না। আবার, অনেকে স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ে – সে যে কারনেই হোক, কিন্তু, মনে হয়, বিদেশে নির্বাসিত ও স্বেচ্ছায় দেশছাড়া মানুষ – দু’জনেরই মনের গহন অনুভূতি গুলো কোথাও যেন অনেকটা একই থাকে। একই ব্যকুলতা, একই রকম নস্টালজিয়া, একই রকম একাকীত্ব।
সুইডেনে যখন গিয়েছিলাম, অক্টোবরের ধূসর শীতে স্টকহোম ও গথেনবার্গের আশেপাশের নির্জন দ্বীপ গুলোয় সত্যিই কেমন এক উদাসীন নির্জন একাকীত্ব জড়িয়ে ছিল, উত্তরের সমুদ্রের ঢেউয়ের পাড়ে এসে আছড়ে পড়ার মধ্যে জড়িয়ে ছিল এক উথালি পাথালি ব্যকুলতা। আর এমন এক নির্জনতায়, প্রকৃতির উদাসীন সৌন্দর্যের দেশে এসে নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে, নিজের একাকী নির্জনতার দিকে তাকালে, সত্যিই মনে হয় – আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো, প্রিয় দে…শ…।
মানুষের কাছে দেশ কি এক ভৌগলিক পরিসীমা? নাকি এক অভ্যেস, এক মুক্ত স্বাধীন দৃষ্টি ভঙ্গি, নাকি চেনা লোকজন, চেনা পাড়া, চেনা গলিপথ, চেনা সৌরভ, চেনা প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকার – দেশ কি?
ছেলেবেলায় বাড়ীর রান্নার লোককে দেখতাম ছুটি নিয়ে দেশে যেত। তার কাছে দেশ মানে ছিল তার অতি চেনা গ্রামের চেনা পরিধি টুকু। এমনকি, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, চেনা জায়গা বদলে প্রাণীদেরও খুব কষ্ট হয়, আবার সেই চেনা জায়গায় ফিরে গেলে দেখা গেছে সে আবার খুশী হয়েছে।
আমার মনে হয়, আবার দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলে এই প্রশ্ন ও উত্তরটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। তখন বিদেশের কাজ, ব্যস্ত জীবন যাপন ও চেনা পরিধির মধ্যে থেকে থেকে দিব্যি নিজের এক comfort zone খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না, দিব্যি দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়, মানিয়ে নেওয়া যায়, সিস্টেমের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু, অবচেতন মনের কোথাও যেন শিকড় ছেঁড়ার এক গোপন চিনচিনে ব্যথা, একফালি একাকীত্ব চাপা পড়ে থাকে। বয়স যতই বাড়ে সেই গোপন ব্যথারা মাথাচাড়া দিতে চায় – তখন ‘দেশ’ নামক এক মিষ্টি অনুভূতিকে মিস করতে শুরু করি, আর সেই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোঁজা শুরু হয়। আর সেই জন্যেই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি ‘নির্বাসিত’ ছবির জন্যে।
প্রবাসী জীবন কেমন তা প্রবাসে যারা থাকেন তাঁরাই কেবল জানেন। আমি দেশেই আছি। আমার বন্ধুদের কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, কেউ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশে ভালো আছি কি না জানিনা। তবে বিদেশে যাবার সাধ আমার নেই। যারা প্রবাসে বসে স্বদেশের জন্য বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছি।
আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা রইলো।
ধন্যবাদ। আসলে কি বলুন তো। ভালো থাকা বা না থাকাটা – অনেকটা ঠিক মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুরের মতো – ডায়নামিক। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন কখনো মনে হয় – এই তো ভালো আছি, আবার কখনো মনে হয় নাঃ ভালো নেই, ওরাই হয়তো ভালো আছে। আসলে মানুষ মনটাকে তো সঙ্গে নিয়েই ঘোরে। আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে দেশ বা বিদেশ যেখানেই থাকা হোক না কেন – থাকাটা কিন্তু এক চেনা পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, দেশে যখন ফিরি নিজের আপন জনের কাছেই ফিরি, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ বা দেশ চালাতে ফিরি না, কিংবা দেশের কোন সিস্টেমকে পালটে দিতে ফিরি না।
দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে থেকেও যখন কেউ বহুদিন গ্রামে থেকে যাওয়ার পরে, গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়, তার মনে কিন্তু গ্রামই বাস করে, সেও তার শিকড় গ্রামেই ছেড়ে আসে। তাই মনে হয়, দেশের ভৌগলিক সীমানায় থেকেও অনেক সময় শিকড় ছেঁড়ার অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, দেশ মানে কোন পাসপোর্ট, বা সীমানা নয়, দেশ এক অনুভূতি, প্রিয়জনের স্মৃতি – মানুষ যেখানেই সেই স্মৃতি গুলো তৈরি করে, তাই একসময় তার দেশ হয়ে ওঠে।
যাইহোক, পৃথিবীর সব দেশের মুদ্রারই দুই পিঠ আছে – কখনো এ পিঠ কখনো বা ও পিঠ, এই নিয়েই চলছে। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।