মে মাসের মাঝামঝি সময়ে, প্রথম তুলুসে পৌঁছনোর পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছিল ঘন ঘোর বৃষ্টির দিন – বেশ কয়েক দিন ধরেই সারা দিনই আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা ছিল, সেই সময় তুলুসে এসেই শিলা বৃষ্টি থেকে শুরু করে ঝিরঝিরে, ইলশেগুঁড়ি, অঝোর ধারা – নানান ধরণের বৃষ্টির নমুনা দেখে নিয়েছিলাম। শুরুর দিকে তখন শহরের একদম মাঝেই আমাদের অস্থায়ী আস্থানা ছিল।
একপাশে ছিল তুলুসের ক্যাথিড্রাল Saint-Étienne de Toulouse, ও la prefecture – তাই এই গোলাপি শহরের পুরনো গথিক, বারোক ইত্যাদি নানা স্থাপত্যের সঙ্গে প্রথমেই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল – আর সেই অঝোর বৃষ্টির দিনে সেই প্রাচীন বিল্ডিং গুলোর ছাদ থেকে জল পড়া আমার নজর কেড়ে নিয়েছিল – আসলে ছাদ থেকে জল পড়ার পাইপ গুলো পাথরে তৈরি এক একটা জন্তুর মুখ – সিংহ, নেকড়ে বা শিয়ালের মতো দেখতে এক একটা, আর প্র্যত্যেকটা জন্তুর মুখ একে ওপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, মনে হয় যেন প্র্যত্যেকটা জন্তুর মুখকেই শিল্পী সযত্নে তৈরি করেছে – আমার কাছে ছাদ থেকে জল পড়ার এই ব্যবস্থা খুবই অভিনব লেগেছিল।
তারপর তো কতো দিন চলে গেছে, প্রথম দিকের সমস্ত অভিনবত্বে ধুলো জমে দৈনন্দিনতায় পরিণত হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই আর বৃষ্টির দিনে তুলুস ক্যাথিড্রালের ছাদ থেকে জল পড়া আর চোখেও পড়ে না।
আবার নতুন করে সেই পাথুরে জন্তুর মুখ গুলোকে ভালো ভাবে, কাছ থেকে দেখলাম – তুলুস মিউজিয়ামে এসে। জানলাম এদের বলে gargoyle, মধ্য যুগের প্রায় সমস্ত স্থাপত্যের এক বিশেষ অংশ এই gargoyle গুলো। ফ্রান্সে বিশেষ করে মধ্য যুগের তৈরি চার্চ, ক্যাথিড্রালের ছাদ থেকে জল পড়ার জন্যে অতি অবশ্যই gargoyle থাকে – যেমন প্যারিসের Notre-Dame ক্যাথিড্রালের ছাদে অনেক gargoyle চোখে পড়ে।
তুলুস মিউজিয়ামে ঢোকার মুখেই লম্বা টানা বারান্দায় নানান ধরণের gargoyle সাজানো – ফ্রান্সের নানা জায়গা থেকে প্রাচীন gargoyle গুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। নীচ থেকে ক্যাথিড্রালের ছাদে gargoyle গুলোকে কতো ছোট দেখায় – কিন্তু বৃষ্টির দিনে বিশাল ঐ জন্তুর মুখ দিয়েই ছাদের জল পড়ে।
প্রাচীন মধ্য যুগে ইউরোপের মানুষ প্রচুর ধৈর্য সহকারে বিশাল বিশাল স্থাপত্যের প্রতিটি সুক্ষ দিকে নজর রেখেছিল, আর সেই ধৈর্যের নমুনা হোক না জন্তুর মুখ, বা কোন অপরূপ ভাস্কর্য, সেই ধৈর্যের নমুনা স্থান পায় মিউজিয়ামে – সংরক্ষিত হয়, সুরক্ষিত হয়, মানুষ দেখে, জানে আর সেই ধৈর্য প্রবাহিত হয়ে চলে মানুষ থেকে মানুষে।