এক আকাশ ঘড়ির গল্প (Prague orloj, Prague, Czech Republic)

আকাশের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারার উপস্থিতি, প্রকৃতির নিয়ম, ও সময়ের ছন্দকে নিজের কবলে নিয়ে আসার জন্যে, পৃথিবীর অসীম রহস্যকে জেনে নেওয়ার জন্যে মানুষের প্রচেষ্টা ছিল বহুদিনের।

প্রকৃতির বুকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা মানুষকে করে তুলেছে কৌতূহলী, অধীর আগ্রহী। মানুষ অনুমান করতে চেয়েছে অনাগত ভবিষ্যতকে, সময়কে। আর, সেই অনুমানের জন্যে সবচেয়ে বড় সংকেত দেয় প্রকৃতি, তার রহস্য, রাতের আকাশের লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাই, মানুষ প্রকৃতিকে জানার প্রথম ধাপে সূর্য, চন্দ্রের উদয় ও অস্তকে হিসাব করে নিয়ে, সেই সময়ের ছন্দকে বেঁধে ফেলেছে নিজের কব্জিতে।

কিন্তু, তার আগের ঘড়ির ইতিহাস যে ছিল বড়ই দীর্ঘ। সময়কে সুক্ষ ভাবে মাপতে চেয়ে মানুষের ইতিহাসে জল ঘড়ি থেকে নিয়ে সূর্য ঘড়ি, যান্ত্রিক ঘড়ি – অনেক রকম ঘড়িই এসেছে।

আর,  সময়কে মেপে নেওয়ার সেই ঐতিহাসিক নিদর্শন হল Prague orloj । প্রাগের একদম শহর কেন্দ্রে অবস্থিত মধ্যযুগীয় এই astronomical ঘড়ির বয়স ছয়শো বছরের উপরে। প্রাগে ১৪১০ এ এই ঘড়ি স্থাপনের সময় থেকেই শহর বাসীর কাছে এক গর্বের বিষয় ছিল, এই ঘড়ি। পৃথিবীতে যে কয়েকটি ঐতিহাসিক astronomical ঘড়ি আছে, এই ঘড়ি তার মধ্যে অন্যতম ও তৃতীয়, এখনো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সচল।

কথিত আছে, প্রাগ বাসীর কাছে এই ঘড়ি এতোই প্রিয় ছিল, যে এই ঘড়ির স্রস্টা Hanuš, যাতে ইউরোপের অন্য  শহরে এমন সুন্দর ঘড়ি আর তৈরি করতে না পারে, তার জন্যে তাঁকে প্রাগবাসীরা অন্ধ করে দিয়েছিল ও Hanuš  নাকি অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এই ঘড়িকে নষ্ট করে দিয়েছিল, যা কিনা একশো বছর ধরে কেউই মেরামত করতে পারে নি। তবে, এই ছয়শো বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এই গল্পের কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই – কিন্তু, মুখরোচকতা আছে।

ঘড়িটি খারাপ হওয়ার প্রায় একশো বছর পরে এই ঘড়িকে ঠিক করে পুনরায় সচল করা হয়। তারপর কয়েকশো বছরের ইতিহাসে এই ঘড়ি অনেক বারই বন্ধ হয়েছে মানুষের প্রচেষ্টা ও মেরামতে আবার সচলও হয়েছে।

প্রাগবাসির অতি প্রিয় এই orloj সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়। জার্মানরা প্রাগ দখল করে নিয়েছিল, এবং orloj ও আশেপাশের বেশ কয়েকটা বিল্ডিংএ আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল জার্মানরা। সেই সময়, ঘড়ির উপরের কাঠের তৈরি মূর্তি – Apostles  গুলোও খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের পরে দীর্ঘ সময় নিয়ে মেরামত করার পর পুনরায় সচল হয়েছিল প্রাগের এই আদরের orloj।

ঐতিহাসিক এই ঘড়ির গায়ে আঁকা নানান সংকেত বছরের নানা সময়ে আকাশে চন্দ্র, সূর্যের অবস্থান থেকে শুরু করে রাশি চক্রের অবস্থানকে সঠিক ভাবে দেখায় আর প্রতি ঘণ্টায় সময় জানান দিয়ে যায়।

প্রাগের কেন্দ্রে এই orloj  এর সময় জানানোর উৎসব দেখতে প্রতি ঘন্টায় হাজার টুরিস্ট এই ঘড়ির নীচে জড়ো হয়। ঘড়ির উপরের জানালা দু’টো খুলে যায়, আর বারোটা মূর্তি ‘Apostles ’ যান্ত্রিক ভাবে সচল হয়ে বেরিয়ে পড়ে – বাজনা সহযোগে ঘড়ির উপরে ওদের প্রসেশন শুরু হয়।

ঘড়ির ঠিক উপরে এক কঙ্কালের হাতে থাকে সময়ের ঘণ্টা, সেও বাজায় তার ঘণ্টা। যেন, প্রতি ঘণ্টায় কঙ্কালটি শহর বাসীকে বা নীচে জমায়েত টুরিস্টদের জানান দিয়ে যায় – মানুষের এই শেষ পরিণতির আগে হাতে সময় যে বড়ই কম। তাড়াতাড়ি কর, এগিয়ে যাও, এখনো অনেক কাজ বাকি, পথ চলা বাকি, গান শোণা বাকি।

About abakprithibi

I see skies of blue and clouds of white, The bright blessed day, the dark sacred night And I think to myself what a wonderful world...........
This entry was posted in Czech Republic, Eastern-Europe, Europe, Travel and tagged , , , , , , , , , , , . Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s