তুলুস বসবাসের শুরুর সময় থেকেই কম্পান্স ক্যাফেরলি বাগানের পথে আমাদের আসা যাওয়া। শুরুর দিকে ছুটির দিনে দেশের অনেকের সঙ্গে দল বেঁধে আসা হত এই বাগানে। তলুস শহরের বুকে প্রায় পঁচিশ একর জমির উপরে এই বাগানের ভেতরেও যে ছোট্ট আরেকটা জাপানিজ বাগান আছে – সেটা শুরুতেই রীতিমত হাস্যকর ভাবে আবিষ্কার করেছিলাম।
ফ্রান্সে এসে শুরুর দিকে সবাই একটু আধটু কাজ চালানো গোছের ফ্রেঞ্চ ভাষাটি শিখে নিতে চেষ্টা করে। তখন অনেকেই সবে এসেছে, আর ফ্রেঞ্চ শিখছে, আমিও শিখতে চেষ্টা করছি। তাই, প্রায় সবাই আমরা চোখের সামনে যা ফ্রেঞ্চ সাইন বোর্ড দেখি, পড়ে নিয়ে তার মর্ম উদ্ধার করার চেষ্টা করি। সেবার, কম্পান্স ক্যাফেরলি বাগানের ভেতরে জাপানিজ গার্ডেনে ঢোকার মুখে এক সাইন বোর্ডে দেখি লেখা ‘pas de chiens’। কোলকাতার বন্ধুটি উত্তেজিত ভাবে তাড়াতাড়ি বলে উঠল – দেখেছিস, দেখেছিস, এই বাগানে চাইনিজদের ঢোকা নিষেধ। কি আশ্চর্য, চাইনিজরা ঢুকতে পারবে না? আমরা পারবো। চল ঢুকি।
ফ্রান্সে নতুন আসা, উপস্থিত সবার ফ্রেঞ্চ জ্ঞান এতোই দুর্বল যে প্রতিবাদ করার সাহস আর কেউই করল না। তাছাড়া, ঐ প্রতাপশালী বন্ধুটির ফরাসী বিদ্যাকে চ্যাল্যেঞ্জ জানিয়ে তর্কে নামার সাহস কারোরই খুব একটা ছিল না। তাই, কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি সবাই ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। আসলে, চাইনিজের ফ্রেঞ্চ ‘chinois’ যার উচ্চারণ ‘চিনোয়া’ আর কুকুরের ফ্রেঞ্চ ‘শিয়া’। বাগানের বোর্ডে লেখা ছিল – ‘কুকুর নয়’। খুবই কাছাকাছি দেখতে এই দুই ফরাসী শব্দে বন্ধুটির ফরাসী বিদ্যা একটু গুলিয়ে গিয়েছিল আর কি। ফরাসী ভাষাটি এতোই গোলকধাঁধাময়।
যাইহোক, সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পার্কের পথে হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় মানুষের নানা ক্রিয়াকলাপ দেখা, মানুষ দেখা আমাদের তুলুস বাসের এক অতি চেনা অঙ্গ বলা যেতে পারে। এই পার্কের সতেজ হাওয়া ফুসফুসে ভরে নিতে অনেকেই এখানে এসে বসে। শীতে রোদ পোহায়। গরমের সময়ে বা শীতের রোদ্র উজ্জ্বল সকালে পার্কে ও পার্কের সমস্ত বেঞ্চ ভরে যায় তুলুসবাসীর কল কাকলিতে।
বছর ঘুরে যায়, এই শহরের বুকে দেখি সময়ের বয়ে চলা, দেখি মানুষের আসা যাওয়া। শীতের শুরুতেই তুলুসের এই কম্পান্স ক্যাফেরলি বাগানের সমস্ত গাছের পাতা গুলো ঝড়ে গিয়ে কেমন এক উদাসীন রূপ তৈরি হয়, বাগানের সারি বাঁধা চেয়ার গুলো পড়ে থাকে শূন্য হয়ে – এক নিঃস্ব রিক্ত ছবি ফুটিয়ে তোলে। ধূসর শীতে প্রকৃতির এই উদাসীনতা দেখে যেন কেমন এক অচেনা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকায়। আর সেই অচেনা কষ্টকে লঘু করতেই যেন আরও জোরে জোরে হাঁটি। পার্কের রাস্তা আরও নির্জন হয়ে পড়ে, শীতের ছোট্ট দুপুর খুবই তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, গাছের ছায়া আরও দীর্ঘ হয়ে যায়। তুলুসের বুকে শান্ত পায়ে শীতের বিকেল নামে হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া নিয়ে। ঘরে ফেরার পথ ধরি।
Very nice photos….
Thank you.