ফ্রান্সের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরেক অহংকার বা গতিময় ধ্বজা হল – TGV মানে Train à Grande Vitesse, ইংরেজিতে হাই স্পিড ট্রেন। যে দিন থেকে এই তীব্র গতির, আভিজাত্যপূর্ণ চেহারার এই ট্রেন ফ্রান্সে এসেছে, ফ্রান্সের মানুষের ট্রেন যাত্রার ধরনই বদলে দিয়েছে। যেন, বদলে দিয়েছে ফ্রান্সের ভৌগলিক সীমারেখা, তীব্র গতির এই ট্রেন ফ্রান্সের নানা প্রান্তের মধ্যে সময়ের দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে ফ্রান্সকে যেন আরও ছোট করে দিয়েছে। আজ এই ট্রেন আধুনিক ফ্রান্সের অন্যতম এক প্রতীক বলা যায়। কিংবা বলা যায় ফ্রান্সের যোগাযোগ ব্যবস্থার মুকুটের এক দামী রত্ন এই ট্রেন।
এই TGV ট্রেন এসে ফ্রান্সের অনেক এরোপ্লেন ব্যবসায় মন্দা এনে দিয়েছিল, জাপানের পরেই ফ্রান্স তীব্র গতির ট্রেন ক্লাবের সদস্য হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮১ তে প্রথম TGV ট্রেন, প্যারিস ও লিওর মধ্যে চলাচল শুরু করেছিল। প্রথমে এই ট্রেন শুধুমাত্র ব্যবসার কাজে যুক্ত মানুষের কথা মাথায় রেখেই ট্রাকে নেমেছিল, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই ট্রেন ফ্রান্সের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে পড়ে – ফ্রান্সের মানুষ এই ট্রেনের প্রেমে পড়ে যায়। আর ফ্রান্সের আরও শহর TGV দিয়ে প্যারিসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, ও TGV ট্রেনের সংখ্যা, চলাচলও দিনে দিনে বাড়তে থাকে।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড়শো কোটি মানুষ যাতায়াত করেছে এই ট্রেনে ও সেদিন থেকে আজও ফ্রান্সের মানুষের গতির অহংকার এই TGV ট্রেন। আজ ফরাসীদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে TGV র গতি এতোই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে, যে ওরা প্রায় ভুলতেই বসেছে, যে এই ট্রেনকে অবলীলায়, বিনা সংঘর্ষে, সুরক্ষিত ভাবে দু’শো কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় চালাতে কি পরিমাণ গবেষণার প্রয়োজন হয়েছে। ১৯৬০ এ ফ্রান্স প্রথম ভাবতে শুরু করে তীব্র গতির ট্রেন চালানোর কথা, আর সত্যিকারের ট্রেন চলতে শুরু করে ১৯৮১তে – কুড়ি বছরের উপর সময় লেগেছে এক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে।
এখনো ফরাসীরা চাকা যুক্ত ট্রেনের আরও আরও তীব্র গতিকে মুঠোয় নিয়ে আসার গবেষণায় নিমগ্ন। এক TGV টেস্ট ট্রেনের সর্বোচ্চ গতির দিকে তাকালে সেটা আরও স্পষ্ট হয় – 574.8 কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা!
তবে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সে শুরু থেকে শেষ স্টপ পর্যন্ত সাধারণ TGV ট্রেনের গড় গতি 279.4 km/h। চীনের তীব্র গতিবেগের ট্রেন আসার আগে পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশী গতিবেগে চলার রেকর্ড, ফ্রান্সের এই TGV ট্রেনের দখলেই ছিল।
প্রতিদিন নতুন টেকনোলোজির জন্ম হচ্ছে, নতুন নতুন দেশ গতির এই প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছে। চীন ট্রেনের গতির অহংকারে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আশা রাখি, আমাদের দেশের প্রতিটি শহরের সঙ্গে রাজধানী যখন TGV দিয়ে যুক্ত হবে – পৃথিবীর সমস্ত দেশের গতির অহং ধুলায় মিশিয়ে দেবে। সম্ভব, সবই সম্ভব, আমাদের দেশের আহমেদাবাদের প্রতি কিলোমিটার অটো রিক্সার দরের চেয়ে সস্তায় যদি মঙ্গল গ্রহের দিকে পাড়ি দিয়ে, সেখানে পৌঁছে যেতে পারে আমাদের দেশের মহাকাশযান, তবে TGV তেও এগিয়ে যেতে পারে নিঃসন্দেহে।