এখানে পাথুরে পাহাড় ও সমুদ্রের নিরন্তর আলাপচারিতায় গুঞ্জরিত হয় পরিবেশ। ছোট্ট ছোট্ট নুড়ি পাথরের সৈকতে মেডিটেরিয়ান সমুদ্র এসে লুটিয়ে পড়ে। ইতালি ও ফ্রান্সের সীমানায়, ছোট্ট এই সীমান্ত শহরটি সারা বছর যেন একটু নির্জন, শান্ত, আন্তর্জাতিক টুরিস্ট মহলের দৃষ্টির আড়ালে, আপন মনে থাকতেই পছন্দ করে। ফ্রেঞ্চ রিভেইরার অন্য শহরের মতো আন্তর্জাতিক স্তরে এতো জনপ্রিয়তাও নেই এর, তবুও ফ্রেঞ্চ রিভেইরার সমস্ত চরিত্র এই শহরে বর্তমান। তাই বোধহয়, এই শহরকে ফরাসীরা আদর করে ফ্রান্সের মুক্তো বা la perle de la France বলে ডাকনাম দিয়েছে। এই শহরে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষের বসবাসের নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছিল, এমনকি এখানে সেই সময়ের মানুষের দেহাবশেষও পাওয়া গিয়েছিল।
Provence-Alpes-Côte d’Azur বা ফ্রেঞ্চ রিভেইরা অঞ্চলের শেষে, ইতালি ও ফ্রান্সের সীমান্তে ফ্রান্সের এই ঘুমন্ত শহর মেন্টনের রাস্তা প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামঝি সময়ে, কমলালেবুর উৎসবের সাজে সেজে ওঠে হলুদ কমলা রঙে – আর সেই উৎসবের সুরে জেগে ওঠে শহর, সাজে নানা রঙে, মুখরিত হয়, মেতে ওঠে হাজার মানুষ। আমরাও সেই উৎসব উপলক্ষে এই শহরে উপস্থিত হয়েছি। সমুদ্র ঘেঁষা শহরে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে যে বড় রাস্তা, সেখানেই বিশাল কার্নিভ্যেলের ব্যবস্থা হয়।
এই শহরে নানান ধরণের প্রচুর লেবু উৎপাদন হয়, তাই নানান ধরণের লেবু যে দৈনন্দিন জীবনে কি কি কাজে লাগতে পারে তারই জীবন্ত প্রদর্শনী এই শহর ও তার রাস্তাঘাটের দোকান পত্র। রাস্তার ধারে সারি বাঁধা ফলন্ত কমলালেবুর গাছ শহরকে সাজায়। ইতালিতে ঢুকে পড়ার ঠিক আগে এই শহরে, ফ্রান্সের অন্যান্য জায়গার চেয়ে অন্তত তিন ডিগ্রি বেশী তাপমাত্রার কারণে শীতের ছুটিতে অনেকেই একটু উষ্ণতার খোঁজে এই শহরে পাড়ি জমায়, বিশেষ করে বয়স্করা। মেডিটেরিয়ানও এখানে যেন একটু উষ্ণ।
ইতালি ঘেঁষা ফরাসী শহর, তাই এখানের বাতাস ইতালির সুবাসে সুবাসিত। রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্ট গুলোর খাওয়া দাওয়া ও রন্ধন প্রণালীর মধ্যে ইতালিরই বেশী প্রভাব দেখা যায়। সমুদ্র সৈকত ছাড়া মেন্টনের প্রধান আকর্ষণ হল এখানের প্রচুর বাগান। আর সেই বিখ্যাত বাগানেই লেবুর তৈরি বিশাল বিশাল স্ট্যাচু, শিল্প কর্ম প্রদর্শনীর খোলামেলা আয়োজন হয়। মেন্টনের এই লেমন কার্নিভ্যেলে অংশ নিতে নানা দেশের শিল্পীদের নিমন্ত্রণ জানায় মেন্টন কতৃপক্ষ। বিগত দিনে ভারতবর্ষ থেকেও শিল্পী দল এসেছিল মেন্টনের কার্নিভ্যেলে অংশ নিতে।
ফ্রেঞ্চ রিভেইরায় এসে উজ্জ্বল দিন দেখতে না পেলে একটু মন খারাপ হয় বই কি, কিন্তু, ফেব্রুয়ারি মাসটাই এখানে এমন, যে ক্ষণিকেই আবহাওয়ার রূপ বদলে যায়। তবে মেডিটেরিয়ানের নুড়ি পাথরের তীরে বসে, মেঘলা ধূসর দিনে সমুদ্রের রং ও কেমন ধূসর হয় দেখতে দেখতে মন খারাপ উবে যায়। সমুদ্র জানে, কি ভাবে মন খারাপের ছায়া মুছে দিতে হয়। মেডিটেরিয়ানের ভেজা হাওয়া সতেজ করে দেয় আমাদের মেন্টন-দিন।