মনে হয় না, ফিনল্যান্ডের যে সাবমেরিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহন করেছিল – তার রঙ এমন দৃষ্টি আকর্ষক রকমের টুকটুকে লাল ছিল।
সাধারণত সাবমেরিনের যে ছবি দেখেছি – শ্যাওলা রঙ, বা ঐ ধরণের কোন এক রঙ। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের সবুজ দ্বীপ Suomenlinna র এক পাশে, নীল আকাশ ও সমুদ্রের প্রেক্ষাপটে যে সাবমেরিনটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, তার রঙ টুকটুকে লাল – দেখে মনে হয় সদ্য রঙ করা হয়েছে।
এই সাবমেরিনটি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই অবসর গ্রহন করেছে, তারপর থেকে ফিনল্যান্ডের এই দ্বীপেই এর বাসস্থান – বর্তমানে মিউজিয়াম হিসাবে কাজ করে। যদিও, সাবমেরিনের ভেতরের অনেক অংশই নেই, যন্ত্র পাতি গুলো খুলে অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, ভেতরে গেলে দেখা যায়, কি ভাবে এক ছোট্ট জায়গার মধ্যে প্রায় কুড়ি জন মানুষ, জলের নিচে, একসঙ্গে থেকে, সাবমেরিনের আভ্যন্তরীণ কাজ গুলো সারতো।
ফিনল্যান্ডের যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে এই সাবমেরিন ফিনল্যান্ড উপসাগরে পাহারার কাজ করতো। এবং যুদ্ধের সময়ে ফিনল্যান্ডের নেভির কাছে যে পাঁচটি সাবমেরিন ছিল – এই ‘Vesikko’ সাবমেরিন তাদের মধ্যে অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার এক মার্চেন্ট জাহাজকে টর্পেডো ছুঁড়ে ডুবিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব এই সাবমেরিনের দখলে – সম্ভবত এটাই এই সাবমেরিনের প্রথম ও শেষ সাফল্য ছিল।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে, ভারসেই শান্তি চুক্তি উলঙ্ঘন করে জার্মানরা এক আধুনিক সাবমেরিন তৈরি করার চেষ্টা করেছিল, এবং, এই সাবমেরিন তৈরি করে ফিনল্যান্ড উপসাগরের জলের নিচে নানা ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষা করছিল – এবং তখন এই সাবমেরিনের সাংকেতিক নাম ছিল CV 707 ।
যে সময়ে এই সাবমেরিন তৈরি হয়েছিল – সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছিল এবং সমসাময়িক সাবমেরিন থেকে এই সাবমেরিন অনেক উন্নত মানের ছিল, জলের নিচে অনেকটাই গভীরে যেতে পারতো। এবং জার্মানরা, ফিনল্যান্ডের দ্বীপপুঞ্জের পাশে এই সাবমেরিনকে টেস্ট করছিল।
তারপর ফিনল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে, এই সাবমেরিন কিনে, নাম দিয়েছিল – Vesikko । এই সাবমেরিন আজ পৃথিবীর একমাত্র জার্মান Type II সাবমেরিনের আদিরূপ, যা আজও বর্তমান – সেই দিক দিয়ে, এই সাবমেরিন, জার্মান সামরিক প্রযুক্তির এক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে প্যারিস চুক্তিতে, ফিনল্যান্ডের উপরে সাবমেরিন রাখার উপরে নিষেধাজ্ঞা হল, এবং সেই নিষেধাজ্ঞা বজায় রইল। তখন ফিনল্যান্ড তাদের চারটে সাবমেরিন বাতিল করে দিয়েছিল। এবং বেলজিয়াম ঐ সাবমেরিন গুলোকে লোহা লক্কড়ের দামে কিনে নিয়েছিল।
কিন্তু ফিনিশ আর্মি এই সাবমেরিন ‘Vesikko’কে রেখে দিয়েছিল – ভেবেছিল, হয়তো ভবিষ্যতে ফিনল্যান্ড আবার সাবমেরিন ব্যবহার করার অধিকার পাবে।
আবার, বেলজিয়াম ঐ সাবমেরিন গুলো কিনে নিয়ে, প্রথম কিছুদিন টুরিস্ট আকর্ষণ হিসাবে ব্যবহার করেছিল – রিতিমত টিকিট কেটে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ব্যবহৃত, এবং বাতিল ঐ জার্মান সাবমেরিন গুলোর ভেতরে ঢোকা যেতো। কয়েকজন ফিনিশ টুরিস্ট সেই কথা বেলজিয়াম ও ফিনল্যান্ড সরকারকে জানায়। এবং সেই চারটে সাবমেরিনকে সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে চুরে বাতিল করা হয়েছিল।
যাইহোক, এদিকে ফিনল্যান্ডের উপরে সাবমেরিন ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা বজায় রইল। এদিকে ‘Vesikko’র বয়সও বেড়ে চলেছে, আধুনিক প্রযুক্তি আরও এগিয়ে গেছে। তাছাড়া, সমুদ্রে পুরনো এই সাবমেরিনের উপস্থিতি অনেক অসুবিধার সৃষ্টিও করেছিল।
তখন ‘Vesikko’কে, বাতিল না করে, আর্মি ও এই সাবমেরিনের প্রাক্তন কর্মীদের সহায়তায় এক আর্মি মিউজিয়ামে পরিণত করার সিদ্ধান্ত হল। সামরিক প্রযুক্তির ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্যে এই সাবমেরিনকে বাঁচিয়ে রাখার আয়োজন করা হল।
দীর্ঘ দিন ধরে, নানা ধরণের সংরক্ষণ ও সংস্কারের পরে এই ‘Vesikko’ সাবমেরিনকে পুনরুদ্ধার করে ১৯৭৩ এ টুরিস্টদের জন্যে খুলে দেওয়া হল। এবং আজ হেলসিঙ্কির কাছে এক সুন্দর দ্বীপ Suomenlinna র অন্যতম আকর্ষণ এই সাবমেরিন। দ্বীপের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে যা চোখে পড়তে বাধ্য।