ভিয়ানা দো কাস্টেলোর ছোট্ট বন্দরে বহু ছোট বড় জাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কোন জাহাজ আবার পাড়ি দেয় মাঝ সমুদ্রে, আবার কোন কোন জাহাজ দিনের পর দিন ঐ বন্দরেই থাকে। ভিয়ানা দো কাস্তেলোর এই বন্দরে জাহাজ মেরামতের কাজও চলে। ঐ নানা ধরণের জাহাজের ভিড়ে, এক ঝকঝকে সাদা জাহাজকে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় – উপস্থিত অন্যান্য জাহাজ গুলো থেকে যাকে অতি অনায়াসে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়।
বেশ লাগে দেখতে। ইউরোপিয়ান সামারের দুপুরের সোনা রোদ্দুর পিঠে মেখে শান্ত বন্দরের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে অনেকেই ভালোবাসে। বিশেষ করে টুরিস্টরা। সাধারণত বন্দর বলতে যে ছবি ভাসে – জাহাজের আনাগোনা, ব্যস্ততা, মানুষের ভিড় – ভিয়ানা দো কাস্টেলো বন্দরের ছবি সেই ছবির সঙ্গে এক্কেবারেই মেলে না।
দূর থেকেই ঐ সাদা জাহাজ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাছে গিয়ে জানলাম, জাহাজটিকে একদম ভেতর থেকে দেখা যায় – টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দাম দুই ইউরো। টিকিট কেটে নিয়ে উনিশ শতাব্দীর জাহাজটির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। অবশ্য পুরনো এই সাদা জাহাজটি টুরিস্টদের জন্যেই খোলা – এক মিউজিয়াম। পর্তুগালের চলে যাওয়া সময়ের এক মিউজিয়াম হয়ে জাহাজটি আজ সেই সময়ের এক ঝলক দেখায়।
যে কোন জিনিসকে একটু গুছিয়ে রাখা, নিজেদের কাছে যা আছে তার নাম দেওয়া, সঠিক মর্যাদা দেওয়া, গুরুত্ব দেওয়া – তা যেন ইউরোপিয়ানদের সহজাত এক প্রবৃত্তি।
ভেতরে গিয়ে জাহাজের কেবিন গুলোর একটির মধ্যে একটি ছোট্ট ডকুমেন্টারি দেখানোর ব্যবস্থা আছে – তবে পর্তুগীজ ভাষায়, আমাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
মাঝ সমুদ্রে পর্তুগীজ জেলেরা যখন দিনের পর দিন জলে ভেসে কড মাছ ধরতে যেত, অনেকেই মাঝ সমুদ্রে অসুস্থ হয়ে পড়ত। মাঝসমুদ্রে সেই জেলেদের চিকিৎসার জন্যে এই জাহাজ ব্যবহার হতো। তাছাড়া, এই জাহাজ মাঝ সমুদ্রে জেলেদের জন্যে চিঠি বিতরণ থেকে শুরু করে, সমুদ্রের বরফ ভাঙ্গা বা পথ দেখানোর কাজ করতো। ষাটের দশকে মাঝ সমুদ্রে কড মাছ ধরার সময়ে এই জাহাজ প্যাসেঞ্জার জাহাজের কাজও করতো।
সত্তরের দশকে যখন এই জাহাজ মাঝ সমুদ্রে তার শেষ যাত্রা করেছিল, জাহাজটির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তারপর বহুদিন লিসবন বন্দরে এই জাহাজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় নোঙর ফেলে দাঁড়িয়েছিল।
অন্যান্য জাহাজের মতোই এই জাহাজটিকে ভেঙ্গে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু, সাতানব্বই এ পর্তুগীজ ইতিহাসবিদরা এই ঐতিহাসিক জাহাজটিকে বাঁচানোর জন্যে আন্দোলন করেছিল। এবং, এই জাহাজটিকে সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে ফেলার ঠিক কয়েকদিন আগেই, প্রায় শেষ মুহূর্তে ওরা এই জাহাজটিকে বাঁচাতে পেরেছিল। এবং ভিয়ানা দো কাস্তেলোর এই বন্দরে এনে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে এই জাহাজের কিছু অংশ মিউজিয়াম রূপে জনসাধারণের জন্যে খোলা ও কিছু অংশে ষাট বেডের ইয়ুথ হোস্টেল তৈরি হয়েছে।
আজও এই হাসপাতাল জাহাজের গায়ে মাঝ সমুদ্রের নোনা গন্ধ থমকে আছে – সময়ের গন্ধ। অতীতের গন্ধ, অতীতের ছবি নিয়ে এই জাহাজ ভিয়ানা দো কাস্টেলো বন্দরে নোঙর ফেলে দিয়েছিল বহু আগে। মাঝ সমুদ্রের হাতছানি উপেক্ষা করে বন্দরকেই করে নিয়েছিল তার শেষ ঠিকানা, শেষ বাসস্থান। পথ কিংবা মাঝসমুদ্র যতই দূরের হাতছানি দিক না কেন, এক সময় সমুদ্রের নোনা গন্ধ মুছে ফেলে কিংবা পথের ধুলোর গন্ধ মুছে নিয়ে পথিককে ঘরে ফিরতেই হয়, জাহাজকে ফিরতে হয় বন্দরে। কোথাও নোঙর ফেলতে হয়।