কোন এক সময়ে, সেই সাদা জাহাজটার পালে লেগেছিল সাত সমুদ্রের নোনা হাওয়া, ছিল দূর দেশের হাতছানি, তাই অ্যাটল্যান্টিক পেরিয়ে, সাত সমুদ্র পেরিয়ে সে পাড়ি দিয়েছিল পৃথিবীর নানা দেশে।
সেই অচেনা অজানা দেশ গুলোর বাতাস কেটে, ডাঙ্গা ছুঁয়ে এগিয়ে গিয়েছিল দূর থেকে দূরে, পালে ছিল দূর দেশের হাওয়ার গন্ধ, সঙ্গে ছিল নানা দেশের গল্প, পথের গল্প, ভেসে যাওয়াতেই ছিল জাহাজটির আনন্দ।
একদিন স্টকহোমে এসে জাহাজটির পথ শেষ হয়েছিল। তখন উনিশ শতাব্দীর এই জাহাজটিকে স্টকহোমবাসীরা সম্পূর্ণ ভাবে সংরক্ষণ করে, এক নতুন জীবন দেয়। ২০০৬ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে জাহাজটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
পুরনো স্টকহোম শহরের সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে দিগন্তে চোখ রাখলে, অতি সহজেই এই সাদা জাহাজ নজর কেড়ে নেয়।
বাল্টিক সমুদ্রের কিনারে প্রায় চোদ্দটা দ্বীপ নিয়ে সুইডেনের রাজধানী শহর স্টকহোম ছড়িয়ে আছে। আর প্রতিটি দ্বীপ সেতু দিয়ে যুক্ত – হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে চলে যাওয়া যায়।
স্টকহোমের শহর কেন্দ্রকে প্রায় জলের উপরেই অবস্থিত বলা যায়। সমুদ্র ও লেক নিয়ে এই শহরের সাধারণ জীবন যাপন, তাই এই শহরের মানুষ, সমুদ্রের প্রতি এক গভীর নাড়ীর টান অনুভব করে।
তাই, এই শহরের প্রায় প্রতিটি কোণে, জলের ধারে, নৌকো, ছোট জাহাজ, মাছ ধরার নৌকোর ভিড় দেখা যায়। কিন্তু, আজকের আধুনিক নৌকো ও জাহাজের ভিড়ে অনায়াসে, উনিশ শতাব্দীর যে জাহাজ নজর কাড়ে – নাম তার – af Chapman। দূর থেকেই এই জাহাজের রাজকীয় ভঙ্গী দৃষ্টি কাড়ে।
ষ্টীলের তৈরি এই জাহাজটি, স্টকহোমের Skeppsholmen দ্বীপের পাশে, নোঙ্গর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯২৩ এ সুইডিশ নেভি এই জাহাজটি কিনেছিল। ১৯৩৪ এ এই জাহাজ তার শেষ সমুদ্র যাত্রা করেছিল।
তারপর, এই জাহাজ সুইডিশ নেভির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে এই জাহাজ সুইডিশ আর্মির ব্যারাক জাহাজ হিসাবে ব্যবহার হয়েছিল।
বর্তমানে, সুইডিশ টুরিস্ট এ্যাসোসিয়েশন এই জাহাজটিকে সংরক্ষণ করেছে। এবং জাহাজটির কেবিনে ১২৪ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। উনিশ শতাব্দীর জাহাজটি এখন এক ইয়ুথ হোস্টেল। চমৎকার এক থাকার জায়গা। এখনও যেন এই জাহাজের গায়ে ইতিহাস থমকে আছে।
জানি না, বাল্টিক সমুদ্র তীরে, উনিশ শতাব্দীর এই ঐতিহাসিক, সুইডিশ জাহাজের কেবিনে থাকার অভিজ্ঞতাটি ঠিক কেমন। তবে, নীল সমুদ্রের গায়ে, ঝকঝকে সোনালি রোদ্দুর মাখা, সাদা জাহাজটির রাজকীয় উপস্থিতি সত্যিই মুগ্ধ করে।
প্রচুর টুরিস্ট প্রতিদিন এই জাহাজের ফোটো নেয়। স্টকহোমবাসীদের কাছে এই জাহাজ এক ল্যান্ডমার্ক বলা যায়।
সব জাহাজই একদিন থেমে যায়, থামতে হয়। জাহাজের পথ ফুরায়, ফুরোয় পথের সব লেনদেন।
কিন্তু, জাহাজটির থেকে যাওয়া, রয়ে যাওয়া তো ফুরোয় না। সাদা জাহাজটি স্টকহোমে, বাল্টিক সমুদ্রের তীরে এসে এক নতুন জীবন পায় – এই জীবন শিকড় ছড়ায়, স্তবিরতা দেয়, দেয় স্থায়িত্ব। জাহাজ এখন তার দুই পাশে বয়ে যাওয়া জীবনের প্রতিধ্বনি শুনতে পায়, দেখতে পায়। এখনও জাহাজটিকে, প্রতি মুহূর্তে, বাল্টিক সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে যায়, অবিরত পথের গল্প বলে দিয়ে যায়।