লোকটার স্বপ্ন ছিল শূন্যে হেঁটে যাবে, মেঘের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। একটা, তার, যার আরেক প্রান্ত গিয়ে মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে, তাই তার ধরে সে হেঁটে যাবে। একি সাধারন স্বপ্ন? নাকি বন্য স্বপ্ন, অবাস্তব স্বপ্ন! পাগলামি? হ্যাঁ, পাগলামিই বলা যায়।
কিন্তু, সব মাতাল স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গেলে কি করতে হয়, কেমন করে স্বপ্নকে তাড়া করে যেতে হয়, তা বোধহয়, ঐ বন্য স্বপ্ন যে দেখতে পারে, সেই জানে। সেই মাতাল স্বপ্নের তাড়নাটিকে আমাদের মত সাধারন মানুষ বোধহয় ধারনাও করতে পারবো না।
ঘটনাটা সত্যি। সবাই ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? কেন সে এমন বন্য স্বপ্ন দেখেছে – শূন্যের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন।
না লোকটি নিজেও জানে না, কেন নিউইয়র্ক শহরের দুইটি একশো দশ তলা সমান উঁচু বিল্ডিঙ, টুইন টাওয়ারের মধ্যে দড়ি বেঁধে, সেই দড়ি ধরে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন সে দেখেছিল।
সাধারণ মানুষের কাছে, এমন এক বন্য স্বপ্নকে তাড়া করে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু, সেই সাধারণ ছেলেটিকে তার সেই বন্য স্বপ্নই অসাধারন করেছিল। লোকটি সেই পাগলামিই করেছিল – আর তার সেই আজব স্বপ্নের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল কিছু মানুষ। তারা, তাকে জুগিয়েছিল সাহস। না, ওরা ওকে সাহস যোগায় নি। লোকটার সাহস, লোকটার স্বপ্ন দেখার সাহস, ঐ জুড়ে যাওয়া মানুষ গুলোকে সাহস দিয়েছিল। হয়তো, ঐ মানুষ গুলো এক অসম্ভব স্বপ্নকে সম্ভব করার সেই যজ্ঞে সামিল হতে চেয়ে, নিজেদেরকে ধন্য মনে করেছিল – তাই জুড়ে গিয়েছিল। এক অসম্ভব স্বপ্নকে বিশ্বাস করেছিল তারা। আর লোকটির সেই বন্য স্বপ্ন দেখা ও সেই স্বপ্নকে সে কি ভাবে তাড়া করেছিল, তা দেখতে হলে অবশ্যই The Walk সিনেমাটি দেখতে হয়।
গল্পের শুরুটা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত, সবচেয়ে সুন্দর শহর, স্বপ্নের শহর, ভালবাসার শহর প্যারিসে। প্যারিসের রাস্তার ধারে, এক বৃত্ত এঁকে, সেই বৃত্তের মধ্যে আপন মনে খেলা দেখাতে সে ভালোবাসতো – জ্যাগলিং, এক চাকার সাইকেল চালানো, ব্যলেন্সের খেলা।
আর সে তার দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্যে, দড়ি টাঙ্গানোর জন্যে দুটো শক্ত গাছ কিংবা স্তম্ভের খোঁজ করে যেতো। যেখানেই সে দড়ির উপরে হেঁটে যাওয়ার খেলা দেখানোর সুযোগ পেতো, সে দড়ি বেঁধে, তার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জ্যাগলিং এর খেলা দেখাতো। আর সেই খেলা দেখিয়ে রাস্তার মানুষ খুশি হয়ে যা দিত, তা দিয়েই তার দিন গুলো চলেছিল এক একটি দিনের পিছে পিছে।
একদিন, সে তার স্বপ্নের খোঁজ পেয়ে গেল। দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে অপেক্ষা করতে গিয়ে, এক ম্যাগাজিনের প্রবন্ধই তার স্বপ্নকে জন্ম দিল। সেই ম্যাগাজিনে আমেরিকার টুইন টাওয়ারের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। লেখা ছিল, এই টুইন টাওয়ার আইফেল টাওয়ারের থেকেও অনেক উঁচু। যেদিন ঐ টুইন টাওয়ার তৈরি হয়ে যাবে, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং হবে।
সেদিনই, মানুষটি ঐ দুই টুইন টাওয়ারের মধ্যে দড়ি বেঁধে, শূন্যে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল। ঐ যে কথায় বলে না – আকাশে প্রাসাদ গড়ার স্বপ্ন যদি দেখেই ফেলো, তাড়াতাড়ি ঐ প্রাসাদে পৌঁছনোর সিঁড়ি তৈরি করতে লেগে যাও। সেই দিন থেকেই, ঐ মানুষটি, শূন্যের মধ্যে হাঁটার জন্যে সিঁড়ির খোঁজ করতে শুরু করে দিয়েছিল।
আর তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল – পাপা রুডির। পাপা রুডির ভুমিকায় Sir Ben Kingsley কে দেখা যায়। পাপা রুডির সার্কাসের দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। তারপর পাপা রুডি ওকে অনেক দড়ি ধরে হাঁটার টিপস দিতে রাজি হয়েছিল।
গল্পটা ফরাসী high-wire artist, Philippe Petit কে নিয়ে। যখন সে প্যারিসের নানা জায়গায় দড়ি বেঁধে হাঁটার প্র্যাকটিস করে চলেছিল, তার নজর চলে গিয়েছিল, নত্রে দাম ক্যাথিড্রালের দুই আকাশচুম্বী চূড়ার দিকে।
রাতে সবার নজর এড়িয়ে, নত্রে দামের ছাদে চেপে, এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ার মধ্যে দড়ি বেঁধে হাঁটার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। সকালে নত্রে দামের সামনে, টুরিস্টদের আগমন শুরু হতেই সে দড়ি বেঁধে, দুই চূড়ার মধ্যে হাঁটা শুরু করেছিল। নিচে দর্শকরা দমবন্ধ করে ওকে দেখে গিয়েছিল। যেহেতু, সরকারের চোখে এই ধরণের কাজ, অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তাই ওকে প্যারিস পুলিশ গেপ্তার করেছিল। কিন্তু, ওর সেই দুঃসাহসিক কাজকে পৃথিবীর অনেক মানুষ, অনেক পত্রিকা সম্মান জানিয়েছিল।
নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারের উপরে হেঁটে যাওয়ার জন্যে – এই ভাবে সে ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরি করে চলেছিল। তার কথায় সেই প্রজেক্টের নাম ছিল – “le coup” । আর টুইন টাওয়ারের মধ্যে দড়ি বেঁধে হাঁটার এই স্বপ্নকে সে বলেছিল – “artistic crime of the century” ।
টুইন টাওয়ারের মধ্যে শূন্যে হেঁটে যাওয়ার জন্যে তাকে যে কত ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনিক জানতে হয়েছিল, প্রচুর তথ্য যোগার করার জন্যে ওকে হাঁটতে হয়েছিল অনেক পথ। একশো দশ তলা উঁচু বিল্ডিঙের উপরে, ঐ উচ্চতায় কত বেগে বাতাস বয়, কি ভাবে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিংএ তার ছুঁড়ে দিয়েছিল, তারের মধ্যে টেনশন তৈরি করেছিল, কতটা নাট-বল্টু লাগাতে হয়েছিল, কি ভাবে তির ধনুক দিয়ে টুইন টাওয়ারের এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং-এ তার ছুঁড়ে দিয়েছিল, কি ভাবে দড়ির সঠিক টেনশন তৈরি করতে গিঁট বাঁধতে হয়, কি ভাবে প্র্যাকটিস করেছিল – তার অনেক আভাস এই সিনেমায় দেখা যায়।
দেখা যায়, সে শুধু অসম্ভব স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকে নি – সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যে অধ্যবসায়কে সে জীবনে ধারন করেছিল। সে অসম্ভব স্বপ্নে সে বসবাস করেছিল। সেই স্বপ্নকে সে জীবন বানিয়েছিল। তাই তো, আজ ইতিহাস ওকে মনে রেখেছে, ওকে নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছে। টুইন টাওয়ারের উচ্চতার অহংকারকে সে তার “artistic crime of the century” দিয়ে জয় করেছে।