অনেকেই আমায় প্রশ্ন করে – ফ্রান্সের জীবন যাপন তোমাকে কি শিখিয়েছে? এক নতুন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন জীবন যাপন তোমাকে কি কি শিখিয়েছে? ছেলেবেলা থেকে এক পরিবেশে বড় হয়ে গিয়ে এক অন্য রকম পরিবেশে মানিয়ে নিতে, জীবন যাপন করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
হয়তো, আমার আগেও যারা যারাই ফ্রান্সে থেকেছে, বা বেড়াতে গেছে – এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আর তারা হয়তো উত্তর খুঁজেছে। জানতে চেয়েছে – ফ্রান্সের জীবন যাপন তাদের কি দিয়েছে?
তাই হয়তো, প্যারিস যুগ যুগ ধরে, পৃথিবীর বহু শিল্পীর প্রেরণা, ফ্রান্স পৃথিবীর বহু মানুষের অতি প্রিয় এক জায়গা। আর ফ্রান্সের মানুষও তাদের অতি প্রিয় ফ্রান্সকে ঐ ভাবেই রাখতে চায়, নিখুঁত ভাবে তাদের শহরের সৌন্দর্যকে সাজিয়ে রাখতে চায় – আর তাই স্বপ্ন চারণের এক দেশ, রোমান্টিকতার এক স্বর্গরাজ্য হিসাবেই মানুষ ফ্রান্সকে দেখে এসেছে।
কিন্তু, ফ্রান্স তো শুধু স্বপ্ন চারণের দেশ নয় – এই সুন্দর দেশটিরও অনেক নিজস্ব সমস্যা আছে, রাজনীতি আছে, আছে দুঃখ, আছে দৈন্য, বিভেদ। পরতে পরতে আছে জীবন ধারণের নানা টানাপোড়েন, নানা ধরণের মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না নিয়েই তো এই দেশটির বুনন। তাই, ফ্রান্সের নানা ধরণের জীবন ধারণকে অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, দেখেছি।
ফ্রান্সে আমাদের বাড়ীর পাশেই এক মূক, অন্ধ ও প্রতিবন্ধীদের এক হাসপাতাল ও এক স্কুল আছে। প্রতিদিন সকালে দেখি – একদল মূক ও অন্ধ ছেলে মেয়ে, দল বেঁধে সেই স্কুলে যায়। রবিবারে ওরা দল বেঁধে হাসপাতালেও যায়।
আর আমি প্রথম থেকেই, বেলকনি থেকে, আশ্চর্য হয়ে দেখতাম, ঐ বাচ্চা গুলো কিন্তু একা একাই ঐ স্কুলে যাওয়া আসা করে – ওদের সঙ্গে ওদের কোন অভিভাবক থাকে না। নিজেরাই ওরা নিজেদের পথ চিনে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করে, একে অপরকে সাহায্য করে। কোন কোন দিন ওরা স্কুল ছুটির পর নীচে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও বলে নেয় – আর প্রত্যেককেই দেখে মনে হয় কোন এক আনন্দ জগতের মানুষ ওরা – সবাই খুব হাসিখুশি।
না, পথচারীদের মধ্যে কেউই ওদের দিকে অন্য নজরে দেখে না, কেউই সহানুভূতি প্রকাশ করে না, কেউই কৌতূহলীও হয় না। আর সেই যে, সমাজে ওরা সাধারণ ভাবে মিশে গিয়ে বাঁচতে পারছে, এতেই ওদের আনন্দ। জীবন তো সহানুভূতি চায় না – চায় স্বাধীনতা।
ফ্রান্সের বাতাসে যেন মুক্ত স্বাধীনতার রেণু ভাসে, চিন্তার স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা, বিজ্ঞানের স্বাধীনতা – তাই তো ফ্রান্স শিল্পীদের স্বাধীন চেতনা প্রকাশের এক প্রিয় জায়গা। ফ্রান্সে এসে যে কোন মানুষই তার চিন্তার, শিল্পের মাধ্যম খোঁজার চেষ্টা করেছে – ফ্রান্স তাদের খালি হাতে ফেরায় নি। কোন না কোন প্রেরণার সন্ধান দিয়েছে।
ফ্রান্সের জীবন যাপন আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু – শিখিয়েছে কি ভাবে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে হয়, কি ভাবে পৃথিবীকে দেখতে হয়, শিখে যেতে হয় প্রতি পদে পদে, উপলব্ধি করতে হয় জীবনকে, জীবন ধারণকে, যাপনকে। ছোট ছোট মুহূর্তে, ছোট ছোট জিনিসে নিজের আনন্দকে খুঁজে নিতে হয়, নিজেকে জুড়ে দিতে হয়, নিমগ্ন হতে হয়।
জীবন ক্যানভাসে, কি ভাবে একটু একটু করে রং ঢেলে যেতে হয় – জীবন ভর। ধৈর্য ধরতে হয়, শীতের রাতে, পরের দিনের সূর্যালোকের অপেক্ষা করতে হয়। কি ভাবে এই চলন্ত, দ্রুত, ব্যস্ত পৃথিবীর মধ্যেই নিজের, অতি নিজস্ব এক পৃথিবী তৈরি করে নিতে হয়।
এখানের জীবন যাপন আমাকে শিখিয়েছে, কি ভাবে একপাশে দাঁড়িয়ে বহমান জীবনকে, চলমান পৃথিবীকে এক গোলাপি কাঁচের রোদ চশমার ভেতর দিয়ে দেখে যেতে হয়। আবার জীবনের সমস্যা থেকে, জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, মুখ ফিরিয়ে থাকা নয়, জীবনের পাশে পাশে চলতে হয়।