ইউরোপের প্রত্যেক প্রাচীন শহর গুলোর এক নিজস্ব ঐতিহাসিক চরিত্র আছে, আছে ছন্দ, গল্প। আর, ঐতিহাসিক শহরের সরু রাস্তা গুলোও কেমন যেন রহস্যময় এক গোলকধাঁধা। আর সেই রহস্যময় প্রাচীনতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক অদ্ভুত আবেদন, অদ্ভুত আলো আঁধারের খেলা, পুরনো দিনের ছাপ।
তারপর, যদি ইউরোপের সেই শহর, পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর জন্ম স্থান হয়, বছরের তিনশো দিনই সেই শহরে সূর্যালোকের আশীর্বাদ থাকে, প্রায় সারা বছরের তাপমাত্রাও সহ্যের মধ্যে থাকে, থাকে উদার সমুদ্র, উন্নত জীবন যাপনের হাতছানি, সামুদ্রিক খাওয়া দাওয়ার প্রাচুর্য – তবে দক্ষিণ স্পেনের শহর, কোস্টা দে সল এর রাজধানী – মালাগা, তো ইউরোপ তথা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে, এক অন্যতম টুরিস্ট গন্ত্যব্য হতে বাধ্য।
আবার, সেই শহরের রহস্যময় অলি গলিতে যদি মেডিটেরিয়ানের সভ্যতার প্রায় দুই হাজার আটশো বছরের ইতিহাসের প্রতিধ্বনি শোণা যায়, গল্প শোণা যায়, যে বন্দর শহরে একবিংশ শতাব্দীর প্রগতি ও ইতিহাস পাশাপাশি বসবাস করতে দ্বিধা করে না, আবার মেডিটেরিয়ানের যে শহরে গ্রীক থেকে শুরু করে রোমান ও আরব সংস্কৃতির প্রাচীন সংমিশ্রণের ছোঁয়াও দেখা যায় – সেই শহর তো ভ্রমণ পিয়াসী মানুষকে টানবেই।
তবে শুনেছি, গত কয়েক শতাব্দী জুড়ে মালাগা শহরের মহিমা একটু আড়ালেই ছিল। আগে, কোস্টা দে সলে বেড়াতে আসা টুরিস্টদের কাছে, মালাগা ছিল শুধুই এক বিশ্রামের জায়গা। তারপর, ধীরে ধীরে কখন যে, ইউরোপের রোদ্দুর প্রিয় ভ্রমণ পিয়াসীরা মালাগার সৌন্দর্যের দিকে ফিরে দেখল – সেও এক রহস্য।
তারপর কয়েক যুগ আগে, পাবলো পিকাসোর পরিবার যখন, পিকাসোর জন্ম শহরে পিকাসো মিউজিয়াম খোলার জন্যে পিকাসোর আঁকা, প্রায় দু’শো ছবি মালাগাকে দিয়ে পিকাসো মিউজিয়ামের সূচনা করেছিল, মালাগা তখন টুরিস্ট গন্ত্যব্য তালিকায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
সাধারণত ইউরোপের প্রাচীন শহর গুলোতে বড় এক রাজপথকে ঘিরেই শহরের জীবন যাপনের স্পন্দন অনুভব করা যায় – আর হয়তো কখনো সেই রাজপথ গিয়ে এক বড় স্কোয়ারে মেশে, স্কোয়ারকে ঘিরে প্রচুর দোকান, কফি শপ, রেস্টুরেন্ট সব নিয়ে এক উৎসবমুখর ছবি তৈরি হয়। মালাগা ঐতিহাসিক শহর কেন্দ্রেও সেই টিপিক্যাল ইউরোপিয়ান চরিত্র লক্ষ্য করা যায়।
তবে, আবার মালাগা শহর কেন্দ্র ইউরোপের অন্যান্য শহর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলেও মনে হয় – জুনের গরম, উজ্জ্বল রোদ্দুর, সমুদ্রের নোনা হাওয়া, মূল সিটি স্কোয়ার Plaza de la Constitución এ খেজুর গাছের সারি, রেস্টুরেন্ট, আন্দালুসিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাজারের মধ্যে অন্যতম মালাগার রঙিন বাজার – সব মিলিয়ে আজকের মালাগাকে সত্যিই অনেক আলাদা বলেই মনে হয়।
তারপর, যখন দেখি, মালাগা শহর কেন্দ্রের ‘Calle Marqués de Larios’ নামের ঐতিহাসিক পথটি দু’পাশে পৃথিবীর যাবতীয় ব্র্যান্ডের শো রুম সাজিয়ে নিয়ে আধুনিকতার দাবী করেও শুধুই পথচারীদের জন্যেই নিবেদিত হয়, জুনের গরমে পথচারীদের ছায়া দেওয়ার জন্যে যখন ছাউনির ব্যবস্থা করা হয় – মালাগা শহর কেন্দ্র তো তখন আলাদা হয়েই যায়। স্থানীয়রা আবার, মালাগার এই বড় রাস্তাকে লন্ডনের Bond Street এর সঙ্গে তুলনা করতেও ভালোবাসে। এই বড় রাস্তা থেকেই পর্যটকদের মালাগা দর্শনের প্রথম ধাপ শুরু হয়।
যদিও, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ দক্ষিণ স্পেনের এই মালাগা শহরের গায়েও লেগেছে, কিন্তু, টুরিস্টদের জন্যে শহরকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে মালাগা কোন ক্রুটি রাখে নি।